জাতীয় সংবাদ | তারিখঃ এপ্রিল ৪, ২০২৩ | নিউজ টি পড়া হয়েছেঃ 3184 বার
নিজস্ব প্রপ্রতিবেদক : ঈদের বাকি প্রায় ১৮ দিন। এই বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসবকে ঘিরে বঙ্গবাজারের সব দোকানেই বিপুল পরিমাণ কাপড় মজুদ করেছিলেন ব্যবসায়ীরা।
মঙ্গলবার সকালে হঠাৎ এই মার্কেটে ভয়াবহ আগুন লাগে। যা পরে ছড়িয়ে পড়ে বঙ্গমার্কেটের সঙ্গে লাগোয়া আদর্শ, ইসলামিয়া ও এনেক্স মার্কেটেও। এসব মার্কেটে আগুন লেগে তছনছ হয়ে যায় ঈদ সামনে রেখে ব্যবসায়ীদের স্বপ্ন।
এদিন সকালে আগুনের কালো ধোঁয়ার বড় বড় কুণ্ডুলির দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বিলাপ করতে করতে বঙ্গবাজারের ঐশী শাড়ি বিতানের মালিক খালিদ হাসান বলেন, ‘এলাকা থেইকা জায়গা বেইচা সেই টাকা দিয়া কয়েকদিন আগে মাল তুলছি। সব পুইড়া গেল। আমার সব শেষ। কিছুই বাঁচলো না।’
ভয়াবহ এ অগ্নিকাণ্ডে নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান চোখের সামনে পুড়ে ছাই হতে দেখেন তিনি। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন ‘খবর শুনেই আয়া দেখি আগুন আর আগুন, আমার এক কোটি টাকার পাঞ্জাবি পুড়ে ছাই।’ ঈদ টার্গেট করে ৪৮ লাখ টাকার শাড়ি বঙ্গবাজার মার্কেটের দোকানে তুলেছিলেন এবং এনেক্সকো টাওয়ারে শাড়ির গুদামে ৬৭ লাখ টাকার মালামাল ছিল।
তিনি বলেন, ‘কয়েকদিন নারায়ণগঞ্জ নিজ এলাকা থেকে জমি বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে ঈদ উপলক্ষে মালামাল তুলেছি। সব শেষ।’
শুধু খালিদ হাসানই নয়, তার মতো শত শত ব্যবসায়ীর এখন মাথায় হাত।
ফুপিয়ে কান্না করে হাসান গার্মেন্টসের মালিক বলেন, ‘ও ভাই, কিছু নাই, সব পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। কয়েকদিন আগে গোডাউনে ৭৫ লাখ টাকার মাল ওঠানো হয়েছে। আমার দুই কোটি টাকার মালামাল পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। গোডাউন, দোকান সব শেষ।’
বঙ্গবাজারে তাদের গোডাউন ও সাতটি দোকান রয়েছে। ভাইকে নিয়ে বঙ্গ মার্কেটে ব্যবসা করেন তিনি। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার ভাইয়ের নাম সাফায়েত। আমার ভাইরে তো খুঁজেই পাচ্ছি না। ও সাফায়েত তুই কই রে ভাই?’
এদিন জীবনের ঝুকি নিয়ে আগুনে পুড়তে থাকা বঙ্গবাজার এবং এর লাগোয়া আদর্শ, ইসলামিয়া ও এনেক্স মার্কেটের কাপড়ের দোকান থেকে মালামাল নিরাপদ স্থানে আনতে দেখা্ যায় অনেক দোকানি ও মহাজনদের। পাশের রাস্তায় কাপড় এনে রেখে এসব কাপড়ের স্তুপের উপর বসে ছলছল নয়নে বসে আছেন কাজল আকতার ময়না৷ নিঃশব্দে গাল বেয়ে পড়ছে তাঁর চোখের জল। কিছুক্ষণ পর পর আর্তনাদ করছেন, ‘আল্লাহ, আমার একি হইয়া গেল। আমার তো কিছুই থাকল না। ঈদের আগেই ফকির হইয়া গেলাম!’
ময়না একজন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা। কামরাঙ্গিরচরে ছোট্ট আ্যামব্রয়ডারির কারখানায় মেয়েদের ‘ওয়ান পিস’ তৈরি করে বঙ্গ, ইসলামিয়া, এনেক্স ও আদর্শ মার্কেটের অন্তত ৩৫টি দোকানে বাকিতে সরবরাহ করেন তিনি। ঈদ সামনে রেখে একটি ক্ষুদ্র ঋণদাতা এনজিওর কাছ থেকে প্রায় ২৫ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেছেন তিনি। চোখের সামনে তাঁর সেই বিনিয়োগ পুড়ে ছাই হয়ে গেল।
আহাজারি করে ময়না বলেন, ‘আইজ থেইকে আমরা তাগাদার টেকা পাইতাম। সেই টেকা দিয়া ইসলামপুরের মহাজনগো বকেয়া পরিশোধ করতাম, সংস্থার কিস্তি দিতাম। এহন কেমনে কী করমু?’
ময়নারা দোকানদারদের সব মালামাল বাকিতে দেন। তারা বিক্রি করে তারপর ময়নাকে টাকা দেয়। তাই ঈদকে সামনে রেখে যত টাকা লগ্নি করেছিলেন এই ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, তার সবই গেছে আগুনে।
সাড়ে ৬ ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে:
সাড়ে ছয় ঘণ্টা দাউদাউ করে জ্বলার পর রাজধানীর বঙ্গবাজারের আগুন দুপুর ১২টা ৩৬ মিনিটে নিয়ন্ত্রণে আসে। আগুনের লেলিহান শিখা নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের অর্ধশতাধিক ইউনিট নিরলস কাজ করে। ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, আগুন এখন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। তবে পুরোপুরি নির্বাপণ হতে সময় লাগবে।
আগুন নিয়ন্ত্রণে বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার দিয়ে পানি ছিটানো হয়। সকাল ৯টার পর থেকে বাহিনীর হেলিকপ্টার দিয়ে পানি নিক্ষেপ করতে দেখা গেছে। তারা হাতিরঝিল থেকে পানি নিয়ে সেখানে ব্যবহার করছেন।
বঙ্গবাজার মার্কেটের পাশেই পুলিশ সদরদপ্তর। কিছু দূরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নগর ভবন। আগুনের ভয়াবহতা এতটাই ছিল যে, এতে পুলিশ সদরদপ্তরের একটি চারতলা ব্যারাক পুড়ে গেছে।
আগুনের সূত্রপাত:
মঙ্গলবার সকাল ৬টা ১০ মিনিটে আগুন লাগার খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। পরে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের টানা ৬ ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।
এর আগে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার সার্ভিসের ৫০টি ইউনিটের সঙ্গে কাজ করছে সেনা, নৌ, বিজিবি ও বিমান বাহিনী। এছাড়াও আগুন নেভাতে যোগ দিয়েছে গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের ফায়ার সর্ভিস।
তবে ইতোমধ্যে প্রায় চার হাজার দোকান পুড়ে ছাই হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তবে এখন পর্যন্ত নিহতের কোনও খবরও পাওয়া যায়নি।
ফায়ার সার্ভিসের তিন সদস্যসহ আহত আটজন হাসপাতালে:
বঙ্গবাজারে ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের তিন সদস্যসহ আটজন আহত হয়েছেন। তাদেরকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) বার্ন ইনস্টিটিউটে জরুরি বিভাগে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
আহতরা হলেন- ফায়ার সার্ভিস কর্মী রবিউল ইসলাম অন্তর, আতিকুর রহমান রাজন এবং মেহেদি হাসান। বাকিরা হলেন; নিলয়, শাহিন, রিপন, রুবেল এবং দুলাল মিয়া। তাদের মধ্যে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি আছেন ফায়ার সার্ভিস কর্মী মেহেদি হাসান।
বঙ্গবাজারে ব্যবসায়ীদের স্বপ্ন পুড়ে ছাই:
ভয়াবহ এ অগ্নিকাণ্ডে ঈদের আগে ব্যবসায়ীদের সব স্বপ্ন পুড়ে ছাই হয়ে গেছে জানিয়ে তাদের আর্তনাদ করতে দেখা গেছে।
মঙ্গলবার সকাল থেকে গুলিস্তান আলাকার আকাশ ধোঁয়ায় কালো হয়ে যায়। এসময় পোশাক ব্যবসায়ীদের হতাশ হয়ে রাস্তায় বসে থাকতে দেখা গেছে।
ফায়ার সার্ভিস অফিসে হামলা, ইট-পাটকেল নিক্ষেপ:
ভয়াবহ আগুন লাগার মধ্যেই পুরান ঢাকার কাজী আলাউদ্দিন রোডে অবস্থিত ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের প্রধান কার্যালয়ে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করেছেন বিক্ষুব্ধ ব্যবসায়ীরা। মঙ্গলবার সকাল ৯টা ২০ মিনিটের দিকে এ ঘটনা ঘটে। এতে ভবনের জানালার গ্লাসগুলো ভেঙে পড়তে দেখা গেছে।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, বঙ্গবাজারের উল্টোপাশে হাঁটা দূরত্বে ফায়ার সার্ভিসের অফিস হলেও আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজে শুরুতে গড়িমসি করেছে তারা। সঠিকভাবে কাজ শুরু করলে এত ভয়াবহ অবস্থা হতো না বলে দাবি তাদের।
পুলিশ জানায়, বেশ কয়েকজন বিক্ষুব্ধ ফায়ার সার্ভিস ভবনে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। এ সময় ভবনের কয়েকটি গ্লাস ভেঙ্গে যায়।
১৯৯৫ সালেও আগুনে পুড়েছিল বঙ্গবাজার:
চারটি ইউনিটে বিভক্ত বঙ্গবাজার ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মালিকানাধীন। এই চার ইউনিট হলো বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স, গুলিস্তান ইউনিট, মহানগর ইউনিট ও আদর্শ ইউনিট। সব মিলিয়ে মোট দোকানের সংখ্যা ২ হাজার ৩৭০টি।
১৯৯৫ সালে একবার ভয়াবহ আগুনে পুড়েছিল বঙ্গবাজার। পরে নতুন করে গড়ে তোলা হয় ওই মার্কেট। সর্বশেষ ২০১৮ সালের ২৪ জুলাই আগুনে গুলিস্তান ইউনিটের কয়েকটি দোকান পুড়ে যায়।