বিশেষ প্রতিবেদক : সরকার বিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের পথনকশাও প্রায় চূড়ান্ত। চলতি মাসেই সরকার পতনের চূড়ান্ত আন্দোলনে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি।

এদিকে এ মাসেই ঢাকায় আসছে যুক্তরাষ্ট্রের একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল। আসতে পারে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদলও।

সবমিলিয়ে চলতি মাস জুলাইকেই রাজনীতির টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে দেখছে বিএনপি।

আগামী ডিসেম্বর বা পরবর্তী জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সে হিসাবে জুলাই মাস শেষ হলে নির্বাচনের খুব বেশি সময় বাকি থাকবে না। শুরু হয়ে যাবে ভোটের প্রস্তুতি। এ সময়ের মধ্যেই নির্বাচনকালীন সরকার গঠন, লেভেল প্লেয়িং মাঠসহ গুরুত্বপূর্ণ দাবি আদায় নিশ্চিত করতে চায় সরকারবিরোধী দলগুলো।

চূড়ান্ত আন্দোলনের ছক তৈরি করতে শরিক দলগুলোর সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করছেন বিএনপি নেতারা। আন্দোলন সফল হলে সরকার পরিচালনায় ৩১ দফার একটি রূপরেখাও প্রায় চূড়ান্ত। এক দফা আন্দোলনে নামার পাশাপাশি দলগুলোর পক্ষ থেকে যৌথ এই রূপরেখাও ঘোষণা করা হতে পারে এ মাসে।

এছাড়া পুরো মাসজুড়ে বিএনপি নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। মূল দল, অঙ্গ এবং সহযোগী সংগঠনের পক্ষ থেকে এসব কর্মসূচি পালন করা হবে।

জুলাইকে টার্নিং পয়েন্ট বলে মনে করছেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল। তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমরা অলরেডি টার্নিং পয়েন্টে আছি। টার্নিং পয়েন্ট শুরু হয়ে গেছে। এখন সময় ও ক্ষণ মেলাবে সরকার। এখন টার্নিং পয়েন্ট কি ইউটার্ন করবে, নাকি এক্সিট করবে- তা নির্ভর করবে সরকারের আচরণের ওপর।’

বিএনপির দলীয় সূত্র জানায়, ভোটাধিকার হরণ,গণতন্ত্রহীনতা, দমন-পীড়নসহ সরকারের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগে মার্কিন ভিসানীতি, ইউরোপীয় ইউনিয়নের উদ্বেগ এবং বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা সরকারের সমালোচনা করার কারণে সরকার পতন আন্দোলনে হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি না দেয়ার পক্ষে দলটির হাইকমান্ড। ২০১৪ সালের পর রাজপথে কার্যত আন্দোলনে ব্যর্থ হলেও গেল বছর অনেকটা ঘুরে দাঁড়ায় বিএনপি। এ বছর আন্দোলনে নিহত হয় দলটির ৭ জন নেতাকর্মী। বিভাগীয় সমাবেশসহ প্রতিটি কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। বিএনপি নেতারা বলছেন, ঘরমুখো নেতাকর্মীদের রাজপথে ফিরিয়ে আনতে পারা বিএনপির প্রথম সফলতা।

দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘জনগণের আন্দোলন কখনও ব্যর্থ হয় না। কখনো সময় বেশি নেয়, কখনো সময় কম নেয়। জনগণের আন্দোলন পরাজিত হয় না। এবারের আন্দোলন শুধু গণতন্ত্র বা ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার আন্দোলন নয়, দেশ বাঁচানোর আন্দোলন।’ বিএনপি নেতারা মনে করছেন, জুলাই-আগস্টের মধ্যেই যা করার করতে হবে। কারণ সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে। তফসিল হয়ে গেলে দলের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে নানা মত তৈরি হতে পারে। তখন আন্দোলন জমানো কঠিন হবে। সরকার তখন বিএনপির মধ্য থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী খুঁজতে পারে। জাতীয় পার্টিসহ আরো কিছু রাজনৈতিক দল নানা হিসাব নিকাশ করে নির্বাচনমুখী হতে পারে। আর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দল তো আছেই। তাই নির্বাচনের হাওয়া শুরু হওয়ার আগেই সরকারকে বিদায় করে বিএনপি নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায় করে নিতে চায় বিএনপি। তারা মনে করে, এই সময়ে সরকারের ওপর সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আন্তর্জাতিক চাপ আরো বাড়বে।

এ বিষয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেয়ার আন্দোলনে ইতিমধ্যে আমরা রাজপথে আছি। সারাদেশে তারুণ্যের সমাবেশ করছি। বিএনপির অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের পদযাত্রা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। সরকার আমাদের দাবি না মানলে চলমান আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হবে।’

বিএনপি বরাবরই আন্দোলনে সারাদেশে অনেকটা সফলতা দেখাতে পারলেও রাজধানীতে সেই অর্থে আন্দোলন জমাতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই এবার অতীতের ভুল ও ব্যর্থতা কাটিয়ে রাজধানীকে নিয়ন্ত্রণ করতে বিভিন্ন কৌশল গ্রহণ করেছেন দলটির নীতিনির্ধারকেরা। এবার ঢাকা মহানগরের পাশাপাশি এর আশপাশের জেলাকেও গুরুত্ব দিচ্ছে বিএনপি।

আন্দোলন সফল করতে গত ছয়মাস রাজধানীর ভাসানী মিলনায়তনে প্রতিদিন ওয়ার্ড ও থানা নেতাদের সঙ্গে কর্মকৌশল নিয়ে সভা করে মহানগর দক্ষিণ ও উত্তর বিএনপির শীর্ষ নেতারা। মহানগরের অঙ্গ সংগঠনের সঙ্গে মহানগর বিএনপির দূরত্ব ঘোচাতে থানাভিত্তিক সমন্বয় সভা করা হয়। আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে রাজধানীকে ১৬টি পয়েন্টে ভাগ করা হয়েছে। এই পয়েন্টগুলো থেকে কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচি একযোগে পালন করা হবে। ইতিমধ্যে এই ১৬টি স্থানে সমাবেশও করেছে দলটি।

বিগত বছরগুলোতে রাজধানীতে আন্দোলনের ব্যর্থতার প্রশ্নে দ্বিমত পোষণ করে বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক আব্দুস সালাম বলেন, ‘ফ্যাসিবাদি সরকারের সব কিছুর হেডকোয়ার্টার রাজধানী। সরকার বিরোধী আন্দোলনে যত খুন, গুম, জেল এবং অত্যাচার এখানেই (রাজধানী) বেশি হয়েছে। শুধুমাত্র রক্ত দিয়েই কোনোকিছুর পরিবর্তন সম্ভব নয়, মননশীল পরিবর্তন প্রয়োজন। খালেদা জিয়ার প্রতি মানুষের ভালোবাসা ছিল বিধায় তিনি ফ্যাস্টিট হননি। বর্তমান সরকার জনবিচ্ছিন্ন হয়ে আজ ফ্যাস্টিট সরকারে রূপ নিয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘জনগণ আর ধুঁকে ধুঁকে মরতে চায় না। মরলে একবারই মরতে চায়। এবার গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে, নিজ অধিকার আদায়ে সরকার পতনের একদফা আন্দোলনে নগরবাসী রাজপথে নামতে প্রস্তুত হয়েছে।’