জাতীয় সংবাদ | তারিখঃ জুন ২২, ২০২৩ | নিউজ টি পড়া হয়েছেঃ 3644 বার
নিজস্ব প্রতিবেদক : দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গাজীপুর, বরিশাল, খুলনা, সিলেট ও রাজশাহী- এই ৫টি সিটি করপোরেশনের ভোট ছিল নির্বাচন কমিশনের জন্য অগ্নিপরীক্ষা। কমিশনও বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নিয়েছিল। রাজনৈতিক দলগুলোও বিষয়টিকে ইসির পরীক্ষা হিসেবেই দেখছিল। সুশীল সমাজের নাগরিকরা বলছিলেন- এটি হবে ভোটে আস্থা ফেরানোর লড়াই।
ইতোমধ্যেই শেষ হয়েছে ৫ সিটির ভোট। বরিশালে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ মনোনীত হাতপাখা প্রতীকের প্রার্থীর ওপর হামলা ছাড়া তেমন কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি এসব নির্বাচনে। সব মিলিয়ে নির্বাচন কমিশন বলছে, এ ভোটে তারা সন্তুষ্ট। অবশ্য রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকেও তেমন কোনো অভিযোগ ওঠেনি ইসির নিরপেক্ষতা নিয়ে।
তবে গতকাল ঢাকা টাইমস এ বিষয়ে কথা বলেছে দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কয়েকজন নেতার সঙ্গে। আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, ‘এসব নির্বাচন সুষ্ঠু ভোটের মডেল হতে পারে। ক্ষমতায় থেকেও কীভাবে নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে হয় তা দেখিয়েছেন শেখ হাসিনা।’
আর বিএনপি নেতারা বলছেন, ভোটের এ দৃশ্যমান নিরপেক্ষতার মোড়কের আড়ালে ছকে বাধা ষড়যন্ত্র রয়েছে। এটি দাবার গুটি। শেখ হাসিনার অধীনে জাতীয় নির্বাচন নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হবে বলে যে শান্তনার টোপ বিএনপিকে গেলাতে চাচ্ছে সরকার- তা সফল হবে না। এ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে বিএনপি যাবে না, হতে দেওয়া হবে না নির্বাচনও।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে স্থানীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ৫টি সিটি করপোরেশনের ভোট সম্পন্ন করেছে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন বর্তমান কমিশন। গাজীপুরকে বাদ দিয়ে বাকি চার সিটির ভোট ছিল অনেকটাই নিরুত্তাপ। এই চার সিটির ভোটে জিতেছেও ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী। অপরদিকে গাজীপুর সিটিতে বিজয়ী হয়েছে আওয়ামী লীগেরই বিদ্রোহী প্রার্থী। সিটি নির্বাচন ‘অবাধ ও সুষ্ঠু’ হলেও মেয়রপ্রার্থীর ওপর হামলার ঘটনায় বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়েছে ইসিকে। হামলার ঘটনার প্রেক্ষাপটে প্রধান নির্বাচন কমিশনের বক্তব্যও বেশ সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। এর জের ধরে দলটি শেষ দফার দুই সিটি নির্বাচন বর্জন করেছে। প্রতিকার চাইতে দলটি শেষ পর্যন্ত আইনি প্রক্রিয়ার দিকে এগোচ্ছে।
তবে সংসদ নির্বাচনের আগে অনুষ্ঠিত এই ৫ সিটি নির্বাচনে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে ইসি। ইসির দাবি এই নির্বাচনের ধারাবাহিকতায় জাতীয় নির্বাচনে ভোটাররা খুব উৎসাহিত হবেন। তারা ভোট কেন্দ্রে যেতে আগ্রহী হবেন।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সস্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম ঢাকা টাইমসকে বলেন, নির্বাচন কমিশন স্বাধীন। তারা তাদের মতো কাজ করে যাচ্ছে। সরকার তাদের উপরে কোনো হস্তক্ষেপ করে না। নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত করেছে- সেটা দেশবাসী দেখেছে। কিছু লোক ও দল থাকেই বিতর্ক সৃষ্টি করার জন্য। যারা নির্বাচন কমিশনকে নিয়ে প্রশ্ন তোলে- তারা আসলে নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়।
আর আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক ঢাকা টাইমসকে বলেন, নির্বাচন ও নির্বাচন কমিশনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চক্রান্ত চলছে। কিন্তু দেশের মানুষ দেখেছে- নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু ও সুন্দর নির্বাচন উপহার দিয়েছে। সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে কোনো বিতর্কের সুযোগ নেই। এটি মডেল নির্বাচন।
তবে আওয়ামী লীগ নেতাদের এমন কথা মানতে নারাজ বিএনপি। জানতে চাইলে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘সবকিছু যখন সাজানো থাকে, যেমন দাবার গুটি যখন ১৫ বছর ধরে পরিকল্পিতভাবে সাজানো। এখানে নতুন করে কেউ এসে সুবিধা করতে পারবে না। সদ্যসমাপ্ত সিটি নির্বাচনে তাই হয়েছে। জাতীয় পার্টি বা হাত পাখা মনে করেছিলো, নির্বাচনে যেহেতু বিএনপি নেই সেখানে তারা সুবিধা করতে পারবে। আসলে জাতীয় পার্টি বা হাতপাখা পেশাদার খেলোয়ার নয়। আওয়ামী বরাবরই পেশাদার। এরা (আওয়ামী লীগ) মুখে সেবাদার কথা বললেও রাজনৈতিক পেশাদার।
আর দলটির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নাল আবদীন ফারুক ঢাকা টাইমসকে বলেন, বিএনপি এ নির্বাচনে অংশ নেয়নি। তাই, এ নির্বাচন কারচুপি হলো নাকি রাতেই কেন্দ্র দখল করলো এ বিষয়ে আমাদের কোন বক্তব্য নেই। বিএনপি আগেই বলেছে এ সরকারের অধীনে আগেও কখনও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না।
তিনি বলেন, আমাদের আন্দোলন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোটের নিশ্চয়তার জন্য। আগামী জাতীয় নির্বাচনে যাতে সরকার ভোট ডাকাতি করতে না পারে, দিনের ভোট রাতে করতে না পারে সেজন্য আন্দোলন অব্যাহত আছে। এবং এ দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আমরা ঘরে ফিরে যাবো না।
অন্যদিকে বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম আজাদ ঢাকা টাইমসকে বলেন, বিএনপি যেহেতু এ নির্বাচনে অংশ নেয়নি, তাই সিটি নির্বাচন নিয়ে কোনো মন্তব্য করবো না। এ সরকারের অধীনে বিএনপি আর কোনো নির্বাচনে অংশ নিবে না, এটা আমাদের শপথ। যতদিন দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে না, জনগণ ভোটাধিকার ফিরে পাবে না ততদিন এ দেশে কোনো জাতীয় নির্বাচন হবে না, হতে দেয়া হবে না।
অবশ্য নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলেছেন, এই নির্বাচনের জন্য স্বস্তির ঢেকুর তোলার সুযোগ নেই। তাদের মতে, সিটি নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হলেই জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার প্রতিফলন ঘটবে এমনটা ভাবার সুযোগ নেই। দুটি নির্বাচন সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। সরকার পরিবর্তনে সংশ্লিষ্ট জাতীয় নির্বাচনকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সঙ্গে কোনোভাবেই মেলানো যাবে না।
প্রসঙ্গত, নির্বাচন কমিশন তিন ধাপে দেশের ৫টি সিটি করপোরেশন নির্বাচন সম্পন্ন করেছে। প্রথমধাপে গত ২৫ মে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপে ১২ জুন খুলনা ও বরিশাল সিটির ভোট হয়। সর্বশেষ ২১ জুন রাজশাহী ও খুলনা সিটির ভোট অনুষ্ঠিত হয়। ৫টি সিটির ভোটই ইভিএমে গ্রহণ করা হয়েছে। এ ভোটের পুরোটাই সিসিটিভির মাধ্যমে ইসি কেন্দ্রীয়ভাবে মনিটর করেছে।
পাঁচ সিটি করপোরেশনের মধ্যে খুলনা, বরিশাল, সিলেট ও রাজশাহীতে আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। অপরদিকে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীকে পরাজিত করে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুন জয়ী হয়েছেন। গাজীপুর বাদে অন্যগুলোতে সেই অর্থে কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়নি। শুরু থেকেই এ নির্বাচন বয়কট করে বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো।
এদিকে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন বর্তমান কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও সুন্দর হয়েছে বলে জানিয়েছেন নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা। তারা নির্বাচনটিকে ‘আইনানুগ ও গ্রহণযোগ্য’ বলে উল্লেখ করেছেন। তারা বলছেন, এই নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলেই আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন তেমনটি হবে এটা বলা যাবে না। তাদের অভিমত, সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট না থাকা কোনও নির্বাচনকে সরকার পরিবর্তন সম্পর্কিত কোনও নির্বাচনের সঙ্গে মেলানো যাবে না।
অবশ্য বর্তমান কমিশনের অধীনে এর আগে অনুষ্ঠিত কুমিল্লা ও রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনও সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছিল। তবে, ফলাফল ঘোষণা নিয়ে কুমিল্লায় কিছুটা সমালোচনা তৈরি হয়েছিল।
পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের বিষয়ে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। গত বুধবার সিলেট ও রাজশাহী সিটির ভোট শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আমরা সন্তুষ্ট বোধ করছি। কোনও রকম অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। ভোটাররা অবাধে, নির্বিঘ্নে এসে ভোট দিয়েছেন।
সিইসি বলেন, পাঁচটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচন ভালো হয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি, জাতীয় নির্বাচন যেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ সেটাতে ভোটাররা খুব উৎসাহিত হবেন যে, ভোট উৎসবমুখর হতে পারে। সেখানে ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যেতে আগ্রহী হবেন।