দুর্নীতির অভিযোগ সীমাহীন, তারপরও পদে থাকবেন নরসিংদীর এসপি?
নিজস্ব প্রতিবেদক : জেলা জুড়ে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ নরসিংদীর পুলিশ সুপার (এসপি) আব্দুল হান্নানের বিরুদ্ধে। অভিযোগের ফিরিস্তিতে কী নেই! পুলিশ সদস্যদের কাছ থেকে ঘুষ আদায়, আদালতের মালখানায় না পাঠিয়ে মাদকদ্রব্য গায়েব করে দেওয়া, নিজে এসপি হতে গিয়ে একজনকে দেওয়া ঘুষের ৫০ লাখ টাকা তুলতে পুলিশকে ব্যবহার, মাদক কারবারি এমনকি পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছ থেকে মাসোহারা আদায়সহ নানান অভিযোগ তার বিরুদ্ধে।
তাছাড়া আওয়ামী লীগের পলাতক নেতা, আওয়ামীপন্থি ব্যবসায়ীদের টার্গেট করে পুলিশ দিয়ে চলছে তার রমরমা বাণিজ্য। পুলিশের এই কর্মকর্তার অনিয়মের অভিযোগ তদন্তে কমিটি হলেও তেমন সক্রিয়তা নেই তাদের। এত অভিযোগের পরও এসপি হান্নান বহাল তবিয়তে আছেন।
বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের ২৭তম ব্যাচের কর্মকর্তা আব্দুল হান্নান গত বছরের ৩০ আগস্ট নরসিংদীর পুলিশ সুপার হন। এর আগে তিনি হবিগঞ্জের ইন-সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারের কমান্ডেন্ট ছিলেন। তার গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহের শৈলকুপার শেখপাড়া গ্রামে। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০২১ সালের ৩ মে আব্দুল হান্নান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার থেকে পদোন্নতি পেয়ে পুলিশ সুপার হন।
ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি এ কে এম আওলাদ হোসেন বলেন, ‘তার (এসপি হান্নান) অভিযোগের বিষয় নজরে এসেছে, আমরা তদন্ত করছি।’
কোন বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে এবং তদন্তের অগ্রগতি কী জানতে চাইলে আওলাদ হোসেন বলেন, ‘সব বিষয়ই দেখা হচ্ছে।’ এর বেশি কিছু বলতে চাননি তিনি।
গত ১৭ ফেব্রুয়ারি মাদক ব্যবসায়ীদের প্রশ্রয় দেওয়াসহ নানান অনিয়মের অভিযোগে চার পুলিশ সুপারকে একযোগে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয় সরকার। এসপি আব্দুল হান্নানের বিরুদ্ধেও একই ধরনের অভিযোগ উঠেছে। তারপরও পদে থাকবেন তিনি?
নরসিংদীর আদালতের মালখানায় না পাঠিয়ে আটক মাদ্রকদ্রব্য গায়েব করে দেওয়ার অভিযোগ ইতিমধ্যে আইজিপির দপ্তরেও পৌঁছেছে। নরসিংদীর এই ঘটনা জানতে পুলিশ সদরদপ্তরের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি করা হবে বলে জানান আইজিপি বাহারুল আলম।
আদালতে গাঁজা বিক্রিতে জড়িত থাকার অভিযোগ
নরসিংদীর আদালতের মালখানায় না পাঠিয়ে আটক ৯৬ কেজি গাঁজা বিক্রির ঘটনায় দেশজুড়ে সমালোচনা হয়েছিল। এই ঘটনায় পুলিশের দুই পরিদর্শক এবং এক জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে। এই ঘটনার পেছনে ছিলেন পুলিশ সুপার আব্দুল হান্নান। কেননা তাকে মাসোহারা দিয়েই মাদক পাচার করে চোরাচালানিরা। কিন্তু অন্য টিমের হাতে আটকা পড়ে এই চালান।
জানা যায়, ৫ ফেব্রুয়ারি নরসিংদীর শিবপুরের সৃষ্টিগড় থেকে ৬ বস্তা গাঁজা উদ্ধার করে ডিবি পুলিশ। প্রতি বস্তায় ১৬ কেজি করে মোট ৯৬ কেজি গাঁজা জেলা গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে আনা হয়। সেখান থেকে কাগজে কলমে এসব গাঁজা আদালতে পাঠানো হয়েছে দেখানো হলেও তা মালখানায় নেওয়া হয়নি। দুই দিন পর কাগজে কলমে গত ১১ মার্চ এ মাদকদ্রব্য ধ্বংস করার প্রমাণপত্র তৈরি করা হয়।
এই ঘটনার পর ডিবি থেকে সরিয়ে ঢাকা রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয় ডিবির পরিদর্শক কামরুজ্জামানকে। ঘটনার পরপর তিনি গণমাধ্যমে বলেন, ‘ডিবির ওসিসহ সব ওসি যা কিছু করেন সব এসপির নির্দেশেই করেন।’
তিনজনের টিম করে টাকা কামান এসপি হান্নান
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন জেলা থেকে এসআই ও এএসআইকে পোস্টিং করিয়ে টাকা নেন এসপি আব্দুল হান্নান। পদপ্রত্যাশীদের জোগাড় করেন সদর থানার ওসি মোহাম্মদ এমদাদুল হক। পতিত সরকারের আমলে ডিবিতে কর্মরত এসআই মোস্তাক ও এএসআই হারেছ মিয়াকে সদর থানায় পোস্টিং করে আনা হয়। একই সঙ্গে এসপির এলাকায় বাড়ি পুলিশ সদস্য রবিউলকেও আনা হয় সেখানে। এই তিনজনের সঙ্গে এসপি হান্নানের অত্যন্ত সু-সম্পর্ক। তারাই মূলত জেলা দাপিয়ে বেড়ান। এদের দিয়ে নানা অনিয়ম-দুর্নীতি করে টাকা কামান এসপি হান্নান।
অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামীলীগপন্থি ও বিতর্কিত ব্যবসায়ীদের তালিকা করে তাদের কাছে পাঠানো হয় ওই তিনজনের কাছে। এরপর তালিকাভুক্ত ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আদায়ের পর তা পৌঁছে দেওয়া হয় এসপি হান্নানের কাছে।
এসপি হতে ৫০ লাখ ঘুষ, অতঃপর…
কর্মজীবনে যেখানে গেছেন সেখানেই বেপরোয়া ঘুষ-বাণিজ্য করেন আব্দুল হান্নান। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে হান্নান জেলার এসপি হিসেবে পোস্টিং নিতে ৫০ লাখ টাকা ঘুষ দেন গোপালগঞ্জের রবিউল ইসলাম নামের এক ব্যক্তিকে। তবে দীর্ঘ চেষ্টায়ও তিনি এসপি হতে পারেননি; টাকাও ফেরত পাচ্ছিলেন না। আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে নরসিংদীর এসপি হিসেবে দায়িত্ব পান আব্দুল হান্নান। এরপরই ঘুষ দেওয়া টাকা উদ্ধারে মাঠে নামান জেলা পুলিশের সদস্যদের। জেলা গোয়েন্দা পুলিশের একজন পরিদর্শককে দিয়ে ঘুষের দেওয়া ৩৪ লাখ টাকা আদায় করেন। একই সঙ্গে রবিউলের ঢাকার দক্ষিণখান এলাকার জমির দলিল ও চেক জব্দ করে নিজের হেফাজতে রাখেন এসপি হান্নান।
অধীন পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছ থেকেও নেন মাসোহারা
ডিবির সদ্য সাবেক পরিদর্শক কামরুজ্জামান বলেন, ‘পুলিশ সুপার হান্নান স্যার প্রায় দিনই আমাদের কাছে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা নিতেন। কিছুদিন আগেও ‘টু লাখ টুমোরো’ মেসেজ দেন। সেটা তাকে পাঠানো হয়। তার আগেও একাধিকবার তার দেওয়া ব্যাংক হিসাবে কয়েক লাখ টাকা দেওয়া হয়। টাকা দিতে দিতে অতিষ্ঠ আমি আর টাকা দিতে না চাইলে তার চক্ষুশূল হয়ে পড়ি। এভাবে তিনি জেলায় কর্মরত বিভিন্ন অফিসারের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা নেন। তাকে জানিয়ে আনা গাঁজার বিশাল চালান বেলাব থানার অন্য টিমের হাতে আটক হলে তিনি তা গায়েব করে দেন।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, এসপি হান্নান টাকা ছাড়া কিছু বোঝেন না। এই সুযোগ লুফে নেন জেলার অসৎ পুলিশ কর্মকর্তারা। তারা নানান অনৈতিক কার্যক্রমে জড়িয়ে যান। রেঞ্জ ডিআইজি অফিসে পাঠানোর নামে অফিসারদের কাছ থেকে টাকা নেন এসপি হান্নান। এছাড়া ডিবির মাইক্রোবাস রিকুইজিশন বিলসহ নানান ইস্যুতে মাঠ পর্যায়ের পুলিশকে ব্যবহার করে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন তিনি।
ঘুষের টাকা যেসব ব্যক্তির কাছে যায়
গত বছরের ২৬ নভেম্বর শেফালি খাতুনের নাম লিখে অগ্রণী ব্যাংকের কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখায় ৫০ হাজার টাকা পাঠাতে মেসেজ পাঠানো হয় কামরুজ্জামানকে। যা নুরুজ্জামান নামে একজন নেন। ইসলামী ব্যাংকের আরেকটি হিসাবে গত ২৬ নভেম্বর ৩০ হাজার টাকা পাঠানো হয়। বিকাশ নম্বরে নেন ১৫ হাজার টাকা।
এরপর গত ৫ জানুয়ারি শাহজাহান আলীর নামে একজনের কাছে ৪২ হাজার টাকা পাঠাতে বলেন এসপি হান্নান। সেই টাকা ইসলামী ব্যাংকের ঝিনাইদহ শাখায় পাঠানো হয়। ১০ ফেব্রুয়ারি রাত ৯টায় নাহিদুজ্জমান নামে একজনের কাছে ২ লাখ টাকা পাঠাতে ডাচ্-বাংলা এজেন্ট ব্যাংকিং নম্বর দেন এসপি হান্নান। পরদিন কামরুজ্জামান সেই টাকা পাঠিয়ে দেন। ১০ মার্চ ডিবির পরিদর্শক কামরুজ্জামানকে মেসেজ দিয়ে সৈয়দুর রহমান নামে এক ব্যক্তির ব্যাংক হিসাবে দুই লাখ টাকা পাঠাতে বলা হয়।
এসপি হান্নানের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে ইতিমধ্যে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এমনকি জেলা আইনশৃঙ্খলা সভায়ও এসপি হান্নানের ঘনিষ্ঠ সেই দুজনের (মোস্তাক ও হারেছ) নাম উঠে আসে। তারা এসপির স্পেশাল অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে পুরো জেলা দাপিয়ে বেড়ান এবং জেলার আইনশৃঙ্খলা অবনতির জন্য তারা দায়ী বলে অভিযোগ করা হয়। ওই সভার পর মোস্তাককে বদলি করা হয়।
নরসিংদী জেলা জামায়াতের আমির মোসলেহ উদ্দিন বলেন, ‘তাকে (এসপি হান্নান) নিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে লেখালেখি হচ্ছে। ব্যক্তিগতভাবে এর বেশি কিছু জানি না আমি।’
এসপি আব্দুল হান্নানের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেন, ‘বিষয়গুলো তদন্ত করা হবে। কোনো পুলিশ কর্মকর্তার ব্যক্তিগত দায় পুলিশ বাহিনী বহন করবে না। আমরা আগামীকাল পুলিশ সদরদপ্তরের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি করব। এখন যেসব অভিযোগ শুনছি তা তদন্তে প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এসব বিষয়ে বক্তব্য চাইতে নরসিংদীর পুলিশ সুপার (এসপি) আব্দুল হান্নানকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
সুত্র : ঢাকা টাইমস।