নির্বাচনের রোডম্যাপ শিগগিরই
অর্থনৈতিক রিপোর্টার : পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেছেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে একটা অনিশ্চয়তা চলছে। নির্বাচনী রোডম্যাপ শিগগিরই আসছে। যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে কাজ করছে সরকার। তখন রাজনৈতিক অস্থিরতা কেটে যাবে। আর নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা হলে বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ বোধ করবেন এবং বাংলাদেশে বিনিয়োগ আসবে।
শনিবার রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে সেন্টার ফর এনআরবি আয়োজিত ‘ব্র্যান্ডিং বাংলাদেশ: এনআরবি অ্যান্ড ইউ এন পিসকিপারস লিডিং দ্য ওয়ে’ শীর্ষক ওয়ার্ল্ড কনফারেন্স সিরিজের উদ্বোধন ও ব্যাংক রেমিট্যান্স অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।
এনআরবি চেয়ারপারসন এম এস সেকিল চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর, লন্ডনের (এলবিটিএইচ) স্পিকার ব্যারিস্টার সাইফ উদ্দিন খালেদ, ব্যাংকার এসোসিয়েশন সভাপতি আব্দুল হাই সরকার, সাবেক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী ফোর্স কমান্ডার মেজর জেনারেল ফজলে এলাহী আকবর (অব.), রেমিট্যান্স বিশেষজ্ঞ ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মো. আব্দুল মান্নান প্রমুখ।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশে কয়েকটি বড় রাজনৈতিক দল আছে। তারা হলো- পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল, কারণ পৃথিবীর কোনো রাজনৈতিক দলের এত শাখা, কর্মী নাই। আমাদের- বিশেষ করে আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং জামায়াত, ক্ষেত্রবিশেষে জাতীয় পার্টির সারা বিশ্বে শাখা আছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে দুই দল, তিন দল প্রচণ্ড শত্রুভাবাপন্ন, একইরকম শত্রুভাবাপন্ন আমাদের প্রবাসীরা, যারা এসব দলের শাখাগুলোতে আছেন। বিদেশে এদের কর্মকাণ্ড দেশের ইমেজ নষ্ট করে।
তৌহিদ হোসেন বলেন, এরকম কী পৃথিবীর কোনো দেশের ক্ষেত্রে আপনারা দেখেছেন? কেউ একজন দেশ থেকে যায় আর তাকে ডিম ছোড়ার জন্য বা তার বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়ার জন্য বিরাট সংখ্যক মানুষ দাঁড়িয়ে আছে? ইস্যুভিত্তিক না, স্রেফ ব্যক্তি এবং দলভিত্তিক যে প্রতিক্রিয়া হয়, এটা বিরাট ক্ষতি করছে আমাদের ইমেজের ক্ষেত্রে, আমাদের ব্র্যান্ডিংয়ের ক্ষেত্রে।’
ভারতের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী কোথাও গেলে সেখানে দুয়োধ্বনি দেয়ার জন্য কেউ দাঁড়িয়ে থাকে না। আমাদের ক্ষেত্রে হয়। এটা আগে থেকেই হয়ে আসছে। এটা থেকে বের হতে হবে। দ্বিতীয়ত, ভারতীয়রা পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যেসব সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে, আমরা পাই না কেন? কারণ আমরা স্থানীয় রাজনীতিতে জড়িত হই খুব কম। আমি যখন দক্ষিণ আফ্রিকায় ছিলাম তখন দেখেছি, ঢাকা থেকে যখন অতিথি গেছে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেও বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের লোকজন একসঙ্গে মিলে সংবর্ধনা দিয়েছে। এটা কিন্তু এক্সেপশনাল, পশ্চিমে কিন্তু আমি তা দেখিনি। আমি দেখেছি সব সময় দুই ভাগ হয়ে আছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় যে এভাবে একসঙ্গে কিছু করার চেষ্টা, এটা আমাদের করতে হবে।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে নতুন সরকার গঠিত হতে যাচ্ছে, সেদিকে তাকান। কতো ভারতীয় গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে চলে আসছেন। আমাদের ক্ষেত্রে কতোটুকু হয়, বরং পাকিস্তানে কিছুটা হচ্ছে। বাংলাদেশিরা টাওয়ার হেমলেটসে কিছু হয়েছে, যুক্তরাজ্যে কয়েকজন এমপি আছেন, এটা হলো বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিংয়ের। ভারত তাদের ডায়াসপোরা তৈরি করেছে। সফটওয়্যার কোম্পানির প্রধান ভারতীয়, এগুলো হচ্ছে আসল রাস্তা ব্র্যান্ডিংয়ের। ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য আমাদের অবশ্যই ভালো কাজ করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, এনআরবিদের ভূমিকা বিশ্বে ইতিবাচক, আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে নেতিবাচকও আছে। সেদিকে আমাদের নজর দিতে হবে। একজন ট্যাক্সিচালকের গাড়িতে ভুল করে কেউ যদি বিপুল পরিমাণ অর্থ ফেলে রেখে যায় এবং তিনি সেটা তার মালিককে খুঁজে বের করে ফেরত দেন, এই ঘটনায় কিন্তু ইমেজ অনেক বেড়ে যায়। কিন্তু যখন দেখা যায়, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে যারা মারা যায় কিংবা উদ্ধার হয় তাদের মধ্যে একটা বড় অংশ বাংলাদেশের, তখন ইমেজ নষ্ট হয়।
তৌহিদ হোসেন বাংলাদেশি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীদের প্রশংসা করে বলেন, তাদের কাজ দেশের বৈশ্বিক ইমেজ উন্নত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
অভিবাসনের খরচ কমানো এবং ভাষার দক্ষতাসহ বাংলাদেশি কর্মীদের দক্ষতা উন্নয়নের ওপরও জোর দিয়ে তৌহিদ হোসেন বলেন, আমরা যদি আমাদের শ্রমশক্তিকে আরও দক্ষ করে তুলতে পারি, তাহলে রেমিট্যান্স দ্বিগুণ করতে পারবো।
মো. তৌহিদ হোসেন দেশের বৈশ্বিক ব্র্যান্ডিং ও প্রভাব বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের (এনআরবি) প্রতি বাংলাদেশের পরিবর্তে তাদের বসবাসরত দেশের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। বলেন, যদি আমরা বৈশ্বিকভাবে প্রভাবশালী হতে চাই, তাহলে এটাই আমাদের পথ। তিনি বলেন, যখন এনআরবিরা তাদের বসবাসের দেশগুলোর গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হন, তখন তা বৈশ্বিক পর্যায়ে বাংলাদেশের একটি শক্তিশালী ব্র্যান্ড ইমেজ গড়ে তোলে।
গত চার মাসে বিদেশে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতীয় মিডিয়া ব্যাপক নেতিবাচক প্রচারণা চালিয়ে আসছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তারা এমন তথ্য প্রচার করছে, যাতে মনে হচ্ছে সীমান্তে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে। বাংলাদেশে হিন্দু সমপ্রদায়ের মানুষকে কচুকাটা করা হচ্ছে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণার মোকাবিলায় বিশেষত ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রচারিত বিভিন্ন মিথ্যা তথ্য খণ্ডন করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, কিছু ঘটনা ঘটেছে, তবে সেগুলো ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে সংখ্যালঘুদের লক্ষ্য করে ছিল না। উদাহরণস্বরূপ, যদি ১০টি বাড়ি আক্রমণ করা হয়, তার মধ্যে ৮টি মুসলমানদের। তিনি প্রবাসীদের প্রতি বাংলাদেশের বিষয়ে মিথ্যা তথ্য মোকাবিলা করার আহ্বান জানান।
উপদেষ্টা আরও বলেন, বিদেশে দূতাবাসগুলোতে প্রবাসীদের প্রয়োজনীয় সহায়তা না পাওয়ার অনেক অভিযোগ সত্য। তবে সব না। এর বাইরেও বিমানবন্দরে প্রবাসীদের হয়রানি করলে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেবে সরকার। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে (এইচএসআইএ) যাত্রী হয়রানি বন্ধে তৎপরতার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি বলেন, এ ধরনের হয়রানির জন্য দায়ীদের বিচার করা হবে।
লন্ডনের (এলবিটিএইচ) স্পিকার ব্যারিস্টার সাইফ উদ্দিন খালেদ বলেন, প্রতিবেশী দেশ ভারতের অনেক প্রবাসী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শীর্ষ স্থান দখল করে আছে। আমরা সেই তুলনায় অনেক পিছিয়ে আছি। আমাদের বাংলাদেশিদেরও এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি। বলেন, যুক্তরাজ্যে এনআরবিরা সব সময় বাংলাদেশের মানুষের পাশে রয়েছে। বাংলাদেশের গরিব-দুঃখী, মেহনতি মানুষের ট্যাক্সের পয়সায় এদেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে লেখাপড়া করে, বিদেশে ডিগ্রি নিয়ে প্রবাসীরা বাংলাদেশের অবস্থানকে বিদেশের মাটিতে জানান দিচ্ছে। এজন্য বাংলাদেশের প্রতি আমাদের রক্ত ঋণ রয়েছে। এই রক্ত ঋণ পরিশোধে অভিপ্রায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে শুরু করে প্রত্যেকটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে এদেশের সন্তানেরা যখন গর্জে উঠেছে, আপনাদের সঙ্গে সঙ্গে প্রবাসীরাও বিশ্বের শীর্ষ স্থানে গর্জে উঠেছে। বাংলাদেশের যখন দুঃখের খবর আপনাদের বুকে আঘাত করে, তখন আমাদেরও বুকে আঘাত করে। বাংলাদেশের কোনো সুখের খবরে প্রবাসে আনন্দে আমাদের বুক ভরে উঠে। বর্তমানে আর্টিফিসিয়াল এন্টিলিজেন্ট (এআই), মেসিন লার্নিং, রোবটিক্স সহ বিভিন্ন প্রযুক্তি দ্রুত সম্প্রসারণ হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশিদের এগিয়ে আসতে হবে। তিনি বলেন, সেদিন বেশি দূরে নয়, যদি দেশে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকে অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজ, এমআইটি, হার্ভার্ড, স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, গুগল, টেসলা, অ্যাপল, ফেসবুক ও মাইক্রোসফটের মতো প্রতিষ্ঠান এই দেশের ঢাকা বা সিলেটে হবে ইনশাআল্লাহ। এজন্য আমাদের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডরের ভূমিকা পালন করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, যেসব বড় বড় গ্রুপ ব্যাংক থেকে টাকা বের করে নিয়ে দেশে-বিদেশে বিনিয়োগ করেছে, সেই টাকা উদ্ধারেও আমরা বিদেশি সংস্থাগুলোর সঙ্গে কাজ করছি। তাদের থেকে আমরা ভালো পরিমাণেই সাড়া পাচ্ছি। এ ছাড়া যারা বিদেশে ১০০ কোটি, ২০০ কোটি টাকা নিয়ে গেছেন, তাদের টাকা উদ্ধারে বিদেশি লিগ্যাল ফার্মের সঙ্গে চুক্তি করা হবে, তারা উদ্ধার করে দিতে পারলে তাদেরকে ১০ শতাংশ প্রণোদনা হিসেবে দেয়া হবে। গভর্নর বলেন, ইদানীং কিছু সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। অ্যাগ্রিগেশন অব রেমিট্যান্স। আমরা দেখছি, কিছু সময় দুবাই থেকে রেমিট্যান্স বেশি আসছে।
এটা ভালো লক্ষণ নয়। সৌদি থেকে রেমিট্যান্স কম আসছে। প্রবাসে যে পরিমাণ বাংলাদেশি রয়েছে, আমরা সেই পরিমাণে রেমিট্যান্স এখনো পাচ্ছি না। আমাদের প্রবাসীরা গড়ে ৩০০ ডলার মাসে আয় করেন। যদিও ইন্দোনেশিয়ার প্রবাসীরা প্রায় ১,২০০ থেকে ১,৫০০ ডলার আয় করেন। আমাদের প্রবাসীদের আরও দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে।
ব্যাংকার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি আবদুল হাই সরকার প্রবাসীদের মধ্যে ঘন ঘন বিরোধ ও সংঘাত নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, এটি একটি দুঃখজনক পরিস্থিতি যা সমাধান করা প্রয়োজন। তিনি বাংলাদেশি শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়নের গুরুত্বও তুলে ধরেন।
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর সাবেক কমান্ডার মেজর জেনারেল (অব.) ফজলে এলাহী আকবর বাংলাদেশের বৈশ্বিক ইমেজ উন্নয়নে সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা উল্লেখ করে বলেন, এটি তাদের শৃঙ্খলা ও স্বচ্ছ রেকর্ডের কারণে সম্ভব হয়েছে।
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মো. আব্দুল মান্নান বলেন, আমাদের যত লোক দেশের বাইরে সেই পরিমাণ রেমিট্যান্স আসে না। এ কারণে দক্ষ লোক পাঠাতে পারলে আরও কয়েকগুণ বেশি রেমিট্যান্স দেশে আসবে বলে মনে করেন তিনি।
যুক্তরাজ্য প্রবাসী আবুল হোসেন বলেন, প্রবাসীদের নিয়ে অনেক কথা হয়। কিন্তু সমস্যার সমাধান খুবই কম।
অনুষ্ঠানে শীর্ষ রেমিট্যান্স সংগ্রহকারী হিসেবে ১০টি ব্যাংককে ক্রেস্ট দেয়া হয়। ব্যাংকগুলো হলো- ইসলামী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংক। এ ছাড়া ব্র্যান্ডিং অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে টিসিবিএল গ্রুপ, ট্রাস্ট ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক ও এমবিটি ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল।