জাতীয় সংবাদ | তারিখঃ সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২৪ | নিউজ টি পড়া হয়েছেঃ 3535 বার
গ্রামের সংবাদ ডেস্ক : প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, উদারনীতি, বহুত্ববাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর মানুষের গভীর বিশ্বাস থেকেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হয়। ১৯৭১ সালে যে মূল্যবোধকে বুকে ধারণ করে আমাদের গণমানুষ যুদ্ধ করেছিল, সেই মূল্যবোধকে বহু বছর পরে আমাদের ‘জেনারেশন জি’ নতুনভাবে দেখতে শিখিয়েছে। বাংলাদেশের এই অভ্যুত্থান আগামীতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মানুষকে মুক্তি ও ন্যায়বিচারের পক্ষে দাঁড়াতে প্রেরণা জোগাবে।
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের একজন কৃষক, একজন শ্রমিকের সন্তানও যেন সমাজের সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছতে পারে সেই লক্ষ্যে বিশাল অবকাঠামো নির্মাণের বদলে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বরাদ্দ, গণমাধ্যম স্বাধীনতায় গুরুত্বারোপ এবং রাষ্ট্রব্যবস্থার সকল পর্যায়ে সুশাসন ফিরিয়ে আনাই আমাদের অভিষ্ঠ লক্ষ্য।’
শুক্রবার নিউ ইয়র্কের স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ১১টায় (বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে ৯টা) জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এসব কথা বলেন।
বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সব রাজনৈতিক দল এখন স্বাধীনভাবে তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারছে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমাদের দেশের মানুষ মুক্তভাবে কথা বলবে, বাধা ছাড়া সমাবেশ করবে, তাদের পছন্দের ব্যক্তিকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবেন এটি আমাদের জাতীয় আকাঙ্ক্ষা এবং এটাই আমাদের লক্ষ্য। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংরক্ষণসহ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সুসংহত করতে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।’
ড. ইউনূস বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমাদের মূল লক্ষ্য যে সব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রীয় কাজে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত তাদের প্রত্যেকের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। আমাদের অগ্রাধিকার মানুষের মৌলিক অধিকার সমুন্নত সুরক্ষিত রাখতে আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।’
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আরও বলেন, ‘প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগুলোর আমূল পরিবর্তনের জন্য পদক্ষেপ নিয়েছি। আমাদের ছাত্রদের আন্দোলন প্রাথমিকভাবে ছিলো বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন। এক পর্যায়ে তা গণআন্দোলনের রূপ নেয়। স্বৈরাচারর ও এক নায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান তৈরি হয়। এই আন্দোলনের মাধ্যমে ফুটে ওঠেছে শিক্ষার্থীদের অভিপ্রায়। যার মধ্যে আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ নিহিত।’
ড. ইউনূস বলেন, ‘আমাদের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ৮শর অধিক প্রাণ কেড়ে নিয়েছে স্বৈরাচারী সরকার। আমি চাই বিশ্ব সম্প্রদায়কে আমাদের নতুন বাংলাদেশের সাথে সম্পৃক্ত হবে।’
জাতিসংঘের মহাসচিবকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বৈশ্বিক সংকট সমূহ নিরসনে জাতিসংঘ মহাসচিবের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ও সাফল্যমন্ডিত নেতৃত্বের জন্য তাকেও জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ।
‘বাংলাদেশ জাতিসংঘসহ যেসব আন্তর্জাতিক আঞ্চলিক এবং দ্বিপাক্ষিক চুক্তির পক্ষভুক্ত সেগুলো প্রতিপালনে আমাদের সরকার বদ্ধপরিকর’ বলেও উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা।
বাংলাদেশ বিশ্বাস করে এই সম্মেলনের অর্জন আমাদের সকলের অর্জনের জন্য সহায়ক হবে। গত জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে তার প্রেক্ষিতে আমি আজকে এখানে বিশ্বনেতাদের সম্মুখীন হতে পেরেছি।
জাতিসংঘ অধিবেশনের ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জুলাই-আগস্টে সংঘটিত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রেক্ষাপট এবং ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের বীরত্বগাথা তুলে ধরে দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর রাষ্ট্র মেরামতের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার গৃহীত সংস্কার কার্যক্রম বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থাপন করেন।
বাংলাদেশের দ্বিতীয় বিজয়ের নতুন যাত্রায় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সুশাসন এবং অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন ব্যবস্থাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে যেসব সংস্কার কর্মসূচি হাতে নিয়েছে ড. ইউনূসের বক্তব্যে সেসব তুলে ধরেন।
এছাড়াও প্রধান উপদেষ্টার বক্তৃতায় আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশের সুদৃঢ় অবস্থান, জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক সংঘাত, রোহিঙ্গা সংকট, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সমস্যা, সম্পদের অবৈধ পাচার রোধ, অভিবাসী অধিকার রক্ষার মতো বিষয়গুলো তুলে ধরেন।
এর আগে ২৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টা জাতিসংঘের স্বাগতিক দেশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আমন্ত্রণে ডিনার পার্টিতে অন্যসব সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের নেতাদের সঙ্গে অংশ নেবে। জাতিসংঘ সদর দপ্তরের কাছে ‘মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্ট’ মিলনায়তনে এই নৈশভোজ অনুষ্ঠিত হয়।
ডিনার পার্টিতে প্রেসিডেন্ট বাইডেন ও ফার্স্টলেডি জিল বাইডেন অতিথিদের স্বাগত জানাবেন। এসময় অতিথিদের সঙ্গে ফটোসেশনেও মিলিত হন মার্কিন ফার্স্টলেডি ও প্রেসিডেন্ট।
এই সফরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের সঙ্গেও বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে যেকোনো প্রয়োজনে বাংলাদেশের পাশে থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা যদি দেশের জন্য এত ত্যাগ স্বীকার করতে পারে, তাহলে তাদেরও (যুক্তরাষ্ট্র সরকার) পূর্ণ সহযোগিতা করা উচিত।’
বৈঠকে অধ্যাপক ইউনূস বিগত সরকারের আমলে সব ধরনের নিপীড়নের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের সাহসী ভূমিকা ও বাংলাদেশ পুনর্গঠনে তাদের গুরুত্বপূর্ণ অবদানের কথা জো বাইডেনকে জানান।
এছাড়া পৃথক বৈঠকে বাংলাদেশে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও অংশীদারমূলক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি জানান যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেন।
জাতিসংঘ অধিবেশনে ভাষণ শেষে রাতেই নিউইয়র্ক থেকে ঢাকার পথে রওনা হবেন প্রধান উপদেষ্টা। গত সোমবার (২৩ সেপ্টেম্বর) জাতিসংঘের ৭৯তম অধিবেশনে যোগ দিতে নিউইয়র্কে পৌঁছান প্রধান উপদেষ্টা।