ডেস্ক রিপোর্ট : বিগত দিনে প্রতি বছরের প্রথম দিনে শিক্ষার্থীরা নতুন বই হাতে পেয়ে আসছে। শিক্ষার্থীদের হাতে সঠিক সময়ে বই পৌঁছে দিতে অন্তত ৬ মাস আগেই কাজ শুরু করে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। দরপত্র আহ্বান, মূল্যায়ন, ক্রয় কমিটির অনুমোদনে প্রায় দুই মাস প্রয়োজন হয় সংস্থাটির। এরপর শুরু হয় বই ছাপার কাজ।

তবে আগামী ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের জন্য এখনো চূড়ান্ত হয়নি পাণ্ডলিপি। ইতোমধ্যে যেসব শ্রেণির বই ছাপার দরপত্র দেয়া হয়েছিল, সেগুলো বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে দুই ভারতীয় প্রকাশককে যেসব লট দেয়ার পরিকল্পনা ছিল, তা বাতিল হলো। নতুন বছরের জন্য প্রায় ৩৫ কোটি বই ছাপানোর উদ্যোগ নেয় এনসিটিবি।

২০২৫ শিক্ষাবর্ষে মূল্যায়নভিত্তিক নতুন শিক্ষাক্রম থাকছে না। পরীক্ষাভিত্তিক পুরোনো শিক্ষাক্রমেই ফেরত যাচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এতে বইয়ের সংখ্যা হবে বেশি। এছাড়া নানা অসংগতির সংস্কার, পরিমার্জন এবং বিষয়বস্তু-প্রচ্ছদেও পরিবর্তন আসছে। পরিবর্তন আসবে মূল্যায়ন পদ্ধতিতেও।

এই পরিমার্জনের কাজটি করছেন ৫০ জনের বেশি বিশেষজ্ঞ। তাই ইতোমধ্যে যেসব শ্রেণির বই ছাপার দরপত্র দেয়া হয়েছিল, সেগুলো বাতিল করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। গত মঙ্গলবার সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটি ওই টেন্ডার বাতিল করে। সেই সঙ্গে নতুন করে টেন্ডার করার সিদ্ধান্ত দেয়। ক্রয় কমিটি এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্ভরযোগ্য সূত্র এসব তথ্য দিয়েছে।

নতুন বছরের শুরুতেই শিক্ষার্থীদের হাতে সব পাঠ্যবই তুলে দেয়া বেশ চ্যালেঞ্জ হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। যদিও এনসিটিবির কর্মকর্তারা বলছেন, শিক্ষাবর্ষের শুরুতেই শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা আছে। নতুন শিক্ষাক্রমের বই ২০২৩ সাল থেকে পড়ছে শিক্ষার্থীরা।

বর্তমানে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী আগামী বছর চতুর্থ, পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালুর মধ্য দিয়ে মাধ্যমিক পর্যন্ত সব শ্রেণিতেই তা চালুর কথা ছিল। কিন্তু এখন নতুন শিক্ষাক্রম কার্যত বাতিল হয়ে গেল।

গত বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, নতুন শিক্ষাক্রমে অনেক দুর্বলতা রয়েছে। বিশেষ করে মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষাক্রম অনেক উইক। তবে আমাদের হাতে সময় নেই। যতটুকু পারি পরিবর্তন করা হবে। এছাড়া জানুয়ারি আসতে বেশি দিন নেই। এর মধ্যে সারা দেশের পাঠ্যবই তৈরি করতে হবে। পরীক্ষা পদ্ধতি ফিরিয়ে আনারও ইঙ্গিত দেন তিনি।

উপদেষ্টা বলেন, বইয়ের মলাটে যা আছে, সেগুলোর সংস্কার করতে হবে। আবার ভেতরে কিছু লেখা যাতে অতিদ্রুত সংশোধন করা যায়। বইয়ের কনটেন্টে কী পরিবর্তন আসবে, তা নির্ধারণে কমিটি গঠনের কথাও জানান তিনি।

এনসিটিবির নিয়ম অনুযায়ী কোনো দরপত্র বাতিল করে পুনঃদরপত্র আহ্বানের জন্য অন্তত ২১ দিন সময় লাগে। এরপর দরপত্র মূল্যায়নে ব্যয় হয় আরো ২০ দিন। ক্রয় কমিটির যাচাই-বাছাই ও ছাড় করতে লাগে অন্তত ১৫-২০ দিন। কাজের অনুমোদন মেলার পর আরো ২৮ দিন সময় ব্যয় হয়।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ পরিপত্রে জানানো হয়েছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নতুন শিক্ষাক্রমের অনেক কিছু বাদ দিয়ে আবারো মাধ্যমিকে বিভাগ (বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও মানবিক) চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ২০১২ সালের শিক্ষাক্রমের অনেক বিষয় ফিরিয়ে আনা হচ্ছে।

নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, যেসব শিক্ষার্থী আগামী বছর নবম শ্রেণিতে উঠবে, তারা পুরোনো শিক্ষাক্রম অনুযায়ী শাখা ও গুচ্ছভিত্তিক পরিমার্জিত পাঠ্যবই (২০২৩ শিক্ষাবর্ষে ব্যবহৃত) পাবে। তারা আগের মতো নবম ও দশম মিলিয়ে দুই শিক্ষাবর্ষে পাঠ্যসূচি শেষ করে ২০২৭ সালে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা দেবে।

এ বিষয়ে বলা হয়, জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০২২-এর বিষয়ে মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতা তথা অংশীজনদের অভিমত, গবেষণা ও জরিপ থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে এ শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির ঘাটতি, পাঠ্য বিষয়বস্তু ও মূল্যায়ন-পদ্ধতি সম্পর্কে অস্পষ্টতা, নেতিবাচক ধারণা, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার অভাব ও নানাবিধ বাস্তব সমস্যা বিদ্যমান থাকায় এ শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নযোগ্য নয় বলে ধারণা করা হয়।

পরিপ্রেক্ষিতেই এসব নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বই ছাপানোর সঙ্গে সম্পৃক্তরা জানান, নতুন এ নিয়মে দশম শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীকে ১০টি অভিন্ন বিষয় পড়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু ২০১২ সালের শিক্ষাক্রম চালু হলে প্রতি ক্লাসে বইয়ের সংখ্যা বাড়বে। যেমন পুরোনো শিক্ষাক্রম অনুযায়ী মাধ্যমিকে বইয়ের সংখ্যা ২৩ (সব কটি সবার জন্য নয়)। ফলে বইয়ের ফর্মার সংখ্যাও বৃদ্ধি পাবে এবং ছাপাতেও সময় বেশি লাগবে।

প্রতি বছরের মতো ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের জন্য প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রায় ৩৫ কোটি বিনা মূল্যের বই ছাপাবে সরকার। দরপত্র ছাড়া এখনো চূড়ান্ত হয়নি পাণ্ডুলিপি। পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের একাধিক কর্মকর্তা জানান, নবম-দশম শ্রেণির জন্য পুরোনো শিক্ষাক্রমেই পাঠ্যবই ছাপানো হবে। থাকবে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগও।

চলতি শিক্ষাবর্ষে যারা নবম শ্রেণিতে বিভাগহীন নতুন শিক্ষাক্রমের বই পড়ছে, আগামী বছর দশম শ্রেণিতে তাদের পুরোনো শিক্ষাক্রমের বই দেয়া হবে। ২০২৬ সালে তাদের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা নেয়া হবে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে।

চলতি শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ৩ কোটি ৮১ লাখের বেশি শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রায় পৌনে ৩১ কোটি বিনা মূল্যের পাঠ্যবই বিতরণ করে সরকার। যেখানে খরচ প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। আর ২০২৫ সালের জন্য প্রায় ৩৫ কোটি পাঠ্যবই বিতরণের লক্ষ্য, যেখানে ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকার বেশি ব্যয় করতে হবে সরকারকে।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বলছে, পরিমার্জনের কাজ চলছে। শিগগিরই পরিপত্র জারি হবে। নির্দিষ্ট সময়ে বই দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে তারা।

চলমান নতুন শিক্ষাক্রমের জন্য যে মূল্যায়ন পদ্ধতি প্রণয়ন করা হয়েছে, তা শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকসহ অনেকের কাছেই স্পষ্ট ও গ্রহণযোগ্য নয়। তাই সে মূল্যায়ন পদ্ধতিকে বাতিল করে একটি স্পষ্ট ও গ্রহণযোগ্য পদ্ধতির জন্য কাজ করছে সরকার।

অন্যদিকে পরিমার্জনের মাধ্যমে পাঠ্যবইয়ে নতুন কিছু বিষয়ও যুক্ত হতে পারে। এই পরিমার্জনের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক ও শিক্ষা নিয়ে কাজ করা একাধিক ব্যক্তি যুক্ত হয়েছেন।