বিলুপ্তির পথে দেশের প্রথম রেলওয়ে স্টেশন ‘জগতি’
- আপডেট: ১২:০২:৪৩ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১ জুলাই ২০২৫
- / ৬৭

বিশেষ প্রতিবেদক, রাশেদুজ্জামান রয়েল : দেশের রেলওয়ের ইতিহাসের সঙ্গে জগতি রেলওয়ে স্টেশনের নাম অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। এই রেল স্টেশনটি কেবল দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার সূচনা তৈরি করেনি বরং এর মাধ্যমে এ অঞ্চলের আর্থসামাজিক পরিবর্তনের পথও খুলে যায়। বাংলাদেশের প্রথম রেলওয়ে স্টেশনটি অবস্থিত কুষ্টিয়ার সদর উপজেলার জগতি এলাকায়। কুষ্টিয়া কোর্ট স্টেশন এবং পোড়াদহ জংশন স্টেশনের মধ্যবর্তী স্থানে রয়েছে জগতি স্টেশন। বর্তমানে ওই স্টেশনটির কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
দেশের প্রথম ঐতিহ্যবাহী রেলওয়ে স্টেশনটি এখন অনেকটা অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। প্রতিদিন এই স্টেশনের বুক চিরে দ্রুতগতিতে ছুটে চলে যায় বেশ কয়েকটি ট্রেন। তবে স্টেশনের উন্নয়নের গতি থেমে আছে যেন একই স্থানে। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় জৌলুস হারিয়ে বর্তমানে স্টেশনটি ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়ে কোনোমতে দাঁড়িয়ে আছে।
গুরুত্বপূর্ণ রেল হেরিটেজ হওয়া সত্ত্বেও এখন স্টেশনটি পরিত্যক্ত হয়ে রয়েছে। রেলওয়ের ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারক বাংলাদেশের প্রথম রেল স্টেশন কুষ্টিয়ার জগতি রেল স্টেশনের অবস্থা জরাজীর্ণ ও খুবই নাজুক। দ্বিতল স্টেশনের ভবনটির ছাদসহ আশপাশের দেয়ালে জন্মেছে আগাছা। ভবনে ধরেছে ফাটল। একসময় বাষ্পচালিত ইঞ্জিনে পানি ব্যবহারের জন্য বিশাল আকৃতির পানির ট্যাংকটিতে জন্মেছে বটগাছ। বর্তমানে স্টেশনটিতে নেই কোনো নিরাপত্তা কর্মী। উন্মুক্ত স্টেশনটির পুরো এলাকা পরিণত হয়েছে চারণভূমিতে।
জানা গেছে, ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর কলকাতার রাণাঘাট থেকে জগতি পর্যন্ত ৫৩.১১ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেলপথ চালু হয়। এই রেলপথটি চালু হওয়ার পর এ অঞ্চলে রেলওয়ের যাত্রা শুরু হয়। পরে ১৮৭১ সালের ১ জানুয়ারি অভ্যন্তরীণ নদীবন্দর গোয়ালন্দ পর্যন্ত ৭৫ কিলোমিটার রেলপথ সম্প্রসারণ করা হয়। এক সময়ে যাত্রীদের কোলাহলে মুখরিত থাকতো এই স্টেশনটি। তবে কর্তৃপক্ষের অবজ্ঞা ও উদাসিনতায় রেলওয়ে বিভাগ ঐতিহ্য হারাচ্ছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। রেলের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বার বার আশ্বাস দিলেও কোনো কাজ হয়নি।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, জগতি রেল স্টেশনটি যেন এক ভুতের আড্ডা। স্টেশন মাস্টার তো দূরের কথা সেখানে গার্ড কিংবা টিকিট কাউন্টারও নেই। নেই যাত্রীদের বসার কোনো স্থান। প্লাটফর্মে জন্মেছে গাছ ও লতাপাতা। অফিস রুমে নেই কোনো জানালা, দরজা থাকলেও তালা দেওয়া। রয়েছে ট্রেনের সিডিউল বোর্ড যা সর্বশেষ ২০০৯ সালের। দ্বিতল ভবনের অফিসের ছাদ থেকে কংক্রিটের সঙ্গে খসে পড়েছে লোহাও। দেয়ালের চারিদিকে ধরেছে ফাটল। কক্ষ থেকে দেখা যাচ্ছে সূর্যের আলো। প্রথমতলায় প্রায় সব কিছু লুটপাট হয়েছে। দ্বিতীয়তলার জানালা থেকে বের হওয়া বটগাছ ও আগাছাগুলো বলে দেয় এর অবহেলার চিত্র। একসময় বাষ্পচালিত ইঞ্জিনের পানি নেওয়ার জন্য জগতির যে দীঘি ও পানির ট্যাংক ব্যবহার হতো সেই দীঘি ও ট্যাংকগুলোর অবস্থা আরও নাজুক।
বিশাল আকৃতির পানির ট্যাংকটি বট গাছের ডালাপালায় ভর্তি হয়ে আছে। আর দীঘিসহ অন্যান্য স্থাপনার অবস্থাও করুণ। বর্তমানে একটা বাতিও জ্বলে না দেশের প্রথম এই স্টেশনটিতে। তবে স্টেশনটি চালু থাকলে দেশের অর্থনৈতিতে বড় অবদান রাখতো।
স্থানীয় বাসিন্দা রোকনুজ্জামান বলেন, “দেশের প্রথম রেলওয়ে স্টেশন হলো এই জগতি স্টেশন। কিন্তু এই স্টেশনে এখন কোনো আন্তঃনগর ট্রেন থামে না। এই স্টেশনে যেন এই রুটের সব আন্তঃনগর ট্রেন থামে তার ব্যবস্থা করার জোর দাবি জানাচ্ছি।”
এই স্টেশনটিকে আধুনিকায়ন করে রেলওয়ের সব সুযোগ সুবিধা চালু করার দাবি করে জাহাঙ্গীর আলম নামের এক ব্যক্তি বলেন, “জগতি স্টেশন একটি ঐতিহ্যবাহী স্টেশন। এর সম্মান রক্ষার্থে সরকারের উদ্যোগ নেওয়া উচিত।”
বাষ্পচালিত ইঞ্জিনে পানি নেওয়ার জন্য তৈরি ট্যাংকে বটগাছ জন্মেছে
একই এলাকার শফিউর রহমান বলেন, “এই স্টেশনটি ব্রিটিশ আমলের তৈরি, বাংলাদেশের ইতিহাসের সাক্ষী। কিন্তু এখানে একটি মাত্র লোকাল ট্রেন ছাড়া কোনো ট্রেন থামে না। ইতিহাস ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে এই স্টেশন পুনরায় চালু ও আধুনিকায়ন করা উচিত। এর ফলে শহরের যানজট কমবে। এটিকে টার্মিনাল স্টেশন হিসেবে আধুনিকায়ন করলে শ্রমজীবী মানুষের জন্য উপকার হবে। এখানে বিভিন্ন শিল্প কলকারাখানা রয়েছে। বিশেষ করে কৃষিপণ্যসহ চাল পরিবহনে বিশেষ সুবিধা হবে। “
সালেহা খাতুন নামে এক নারী বলেন, “একসময় এই স্টেশনটি ছিল জাঁকজমকপূর্ণ। কিন্তু এখন প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। কোনো আন্তঃনগর ট্রেন এখানে থামে না। রেলওয়ে সেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়ে আছে স্টেশনটি। আমরা পুনরায় এই স্টেশনটি চালুর দাবি জানাই। “
এর মধ্যে একাধিকবার আন্তঃনগর ট্রেন থামিয়ে বিক্ষোভ, মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছেন স্থানীয়রা। প্রতিবারই রেলের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আশ্বাসে তারা শান্ত হন। তবে তাদের আশা পূরণ হয়নি।
স্থানীয়দের দাবিগুলো হলো – জগতি রেল ভবনের সংস্কার করতে হবে, জগতি রেলস্টেশনকে আধুনিকায়ন করতে হবে, অনলাইনে টিকিট কেনার ব্যবস্থা করতে হবে, জগতি রেল স্টেশনের প্রথম রেল ভবনকে প্রত্নতাত্ত্বিক মন্ত্রণালয়ের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং জগতি রেল স্টেশনের পুরোনো ভবনের ছবি অনলাইন টিকিটের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে।
শরিফ বিশ্বাস নামের স্থানীয় এক ব্যক্তির বলেন, “বাংলাদেশের প্রথম রেলওয়ে স্টেশন হিসেবে এটির অস্তিত্ব ও ঐতিহ্য রক্ষায় রেল হেরিটেজ হিসেবে গুরুত্ব দিয়ে স্টেশনটির আগের রূপকে অবিকৃত রেখে সংস্কার করা সময়ের দাবি।”
কুষ্টিয়া কোর্ট স্টেশনের ভারপ্রাপ্ত স্টেশন মাস্টার ইতিয়ারা খাতুন জানান, কুষ্টিয়া কোর্ট স্টেশন এবং পোড়াদহ জংশন স্টেশনের মধ্যবর্তী স্থানে রয়েছে জগতি স্টেশন। বর্তমানে ওই স্টেশনটির কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। তবে এটি বাংলাদেশের প্রথম রেল স্টেশন হওয়ায় সেখানে ঐতিহাসিক স্টেশন হিসেবে গণ্য হয়। ব্রিটিশ আমলে এলাকার অর্থনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনায় স্টেশনটি নির্মাণ করা হয়েছিল।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে রেলওয়ের খুলনা বিভাগের গার্ড (গ্রেড ২) মাহবুবুল ইসলাম জানান, দেশের প্রথম রেলওয়ে স্টেশন হলো জগতি। স্টেশনটি বর্তমানে জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। আমরা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবগত করেছি। আশা করছি স্টেশনটির ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।