স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা | তারিখঃ সেপ্টেম্বর ২২, ২০২৩ | নিউজ টি পড়া হয়েছেঃ 5118 বার
সানজিদা আক্তার সান্তনা : আমাদের দেশে লাউ একটি জনপ্রিয় সবজি। লাউ সাধারণত শীতকালীন সবজি। কিন্তু এখন সারা বছরই লাউ চাষ করা হয়।
লাউ একটি পুষ্টিকর এবং সুস্বাদু সবজি। লাউ সহজলভ্য ও দামে সস্তা একটি সবজি। লাউ এর মধ্যে আছে বিপুল পরিমাণে ভিটামিন, গুরুত্বপূর্ণ খনিজ উৎপাদন ও জল থাকার পাশাপাশি এর মধ্যে আছে উপকারী ফাইবার।
লাউ কে আমরা বিভিন্ন রকম ভাবে রান্না করে খায়। যেমন লাউ এর তরকারি, পোস্ত, লাউ মাছের মাথা দিয়ে তরকারি, লাবরা, ভাজি, বড়া কিংবা সালাদ হিসেবেও খাওয়া যায়।
লাউ এর উপকারিতা:
১. লাউ ত্বকের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।
২. লাউ আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
৩. লাউ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
৪. চুলের সমস্যা সমাধান করতে সাহায্য করে লাউ।
৫. লাউ হজম শক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
৬. লাউ খেলে ওজন কম হয়।
৭. যকৃত ভালো রাখতে সাহায্য করে লাউ।
৮. লাউ শরীরকে ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করে।
৯. লাউ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
১০. লাউ হাড় মজবুত করতে সাহায্য করে।
১১. লাউ অনিদ্রা দূর করতে সাহায্য করে।
১২. লাউ হার্টের জন্য উপকারী।
লাউ এর অপকারিতা:
১. লাউ এর রস যদি তেতো হয় তাহলে খাবেন না।
২. অনেক সময় লাউ খেলে অ্যালার্জি হতে পারে।
৩. অতিরিক্ত লাউ খেলে রক্তচাপ হঠাৎ কমে যেতে পারে।
৪. অতিরিক্ত লাউ খেলে রক্তে সুগারের পরিমাণ হঠাৎ কমে যেতে পারে।
লাউকে আমরা বিভিন্নভাবে রান্না করে খেতে পারি। যেমন লাউ এর তরকারি, লাউ এর পোস্ত, লাউ এর নিরামিষ, লাউ এর ভাজি, লাউ এর বড়া, ছোলার ডাল দিয়ে লাউ এর ডাল তরকারি, লাউ এর সঙ্গে মাছের মাথা মিলিয়ে তরকারি, বা সালাদ হিসাবেও খাওয়া যায়।
লাউ এর উপাদান: ভিটামিন সি,ভিটামিন ডি, ভিটামিন বি, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, সোডিয়াম, ফসফরাস, ফোলেট, আইরন, পটাশিয়াম, ফ্যাট, শর্করা ইত্যাদি।
১০০ গ্রাম লাউ এর পুষ্টিগুণ হল:
খাদ্য শক্তি — ১৪ কিলো ক্যালরি, ফাইবার — ০.৫ গ্রাম, আমিষ — ০.৬২ গ্রাম, ফ্যাট — ০.০২ গ্রাম, ভিটামিন সি — ১০.১ মিলিগ্রাম, ম্যাগনেসিয়াম — ১১ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম — ১৫০ মিলিগ্রাম, ক্যালসিয়াম — ২৬ মিলিগ্রাম, সোডিয়াম — ২ মিলিগ্রাম, কোলেস্টেরল — ০.০ মিলিগ্রাম, ফসফরাস — ১৩ মিলিগ্রাম, জিংক — ০.৭ মিলিগ্রাম, আয়রন — ০.২ মিলিগ্রাম।
লাউ এর উপকারিতা:
১. লাউ ত্বকের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। লাউ-এর মধ্যে এমন বিশেষ কিছু উপাদান আছে যা শরীরে গেলে ত্বকের সৌন্দর্য বৃদ্ধি হয় এবং ত্বকের স্বাস্থ্য গঠন হয়। তাই প্রত্যেক দিন খাবারে লাউ রাখলে বেশ উপকার পাওয়া যাবে। মুখে ব্রণের সমস্যা সমাধান হবে। কারণ লাউয়ের মধ্যে আছে ভিটামিন সি।
২. লাউ আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। লাউ আমাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। কারণ লাউয়ের মধ্যে আছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে বিশেষভাবে সাহায্য করে।
৩. লাউ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। লাউ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে বিশেষ উপকারী। কারণ লাউ এর মধ্যে শর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখার উপাদান গুলি উপস্থিত আছে। তাই যে সব রোগী ডায়াবেটিস কে ভুগছেন তারা প্রতিদিন খাবারে পরিমাণ মতো লাউ এর কোন পদ রাখতে পারেন এতে উপকার পাবেন।
৪. চুলের সমস্যা সমাধান করতে সাহায্য করে লাউ। চুল পড়ে যাওয়ার মতো সমস্যার সমাধান করতে পারে লাউ। কারণ লাউ এর মধ্যে আছে ভিটামিন বি, যা চুল পড়া রোধ করতে সাহায্য করে।
৫. লাউ হজম শক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। লাউ খুব সহজে হজম হয়। তাই গরমকালে যখন আমাদের পাচনতন্ত্র দুর্বল থাকে, তখন যদি লাউ খাওয়া হয় তাহলে সহজেই হজম হয়ে যায়। ফলে লাউ খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়ে যায়। গ্যাস, অম্বল, বদহজম এইসব রকমের সমাধান শুধু লাউয়ের মধ্যেই আছে।
৬. লাউ খেলে ওজন কম হয়। লাউ ওজন কমাতে সাহায্য করে। কারণ লাউয়ের মধ্যে ক্যালরির পরিমাণ কম আছে। এছাড়াও ভিটামিন, খনিজ ও পুষ্টিকর ফাইবার থাকে তাই আমাদের শরীরে যথেষ্ট পুষ্টি পাওয়া যায়। লাউ এর মধ্যে আছে ভিটামিন কে। যা বিপাকে সাহায্য করে।
৭. যকৃত ভালো রাখতে সাহায্য করে লাউ। লাউ আমাদের শরীরের যকৃত কে ভালো রাখতে সাহায্য করে। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের মতে যকৃত ভালো রাখে এবং যকৃতের ফোলা রোধ করতে লাউ বিশেষ উপকারী।
৮. লাউ শরীরকে ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করে। গরমের সময় আমাদের শরীরকে ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করে লাউ। লাউ এর মধ্যে কোলিন নামক একটি নিউরোট্রান্সমিটার আছে। যা মস্তিষ্ককে সতেজ রাখতে সাহায্য করে। ফলে মানসিক অস্থিরতা, বিষন্নতা এবং অন্যান্য কোন মানসিক চঞ্চলতা হয় না। মস্তিষ্ক কে সতেজ রাখার সাথে সাথে মনোযোগ বৃদ্ধি করতে লাউ এর মত আর কোন সবজি হয় না।
৯. লাউ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। যারা উচ্চ রক্তচাপের সমস্যায় ভুগছেন, তারা তাদের খাদ্য তালিকায় লাউ রাখতে পারেন। কারণ লাউ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
১০. লাউ হাড় মজবুত করতে সাহায্য করে। লাউ খেলে আমাদের হাড় এবং দাঁত মজবুত হয়। কারণ লাউয়ের মধ্যে আছে পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্যালসিয়াম। যা আমাদের হাড় এবং দাঁত উভয়ই সুস্থ রাখতে এবং মজবুত রাখতে সাহায্য করে।
১১. লাউ অনিদ্রা দূর করতে সাহায্য করে। লাউ এর পাতা খেলে আমাদের মস্তিষ্ক ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করে। এছাড়াও ঘুমের সমস্যা সমাধান করতে সাহায্য করে। দেহে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে লাউ।
১২. লাউ হার্টের জন্য উপকারী। লাউ হার্টের জন্য খুব উপকারী একটি সবজি। প্রতি সপ্তাহে কম করে তিনবার লাউ এর রস খেলে হার্টের স্বাস্থ্য সঠিকভাবে বজায় থাকে। এবং রক্তচাপ স্বাভাবিক থাকে। কারণ লাউয়ের মধ্যে কোলেস্টেরল নেই বললেই চলে।
রান্না না করে যদি লাউ এর রস করে খান। লাউ এর রস সবাই খেতে পারেন। বিশেষ করে যারা ডায়াবেটিসের রোগী তাদের জন্য লাউয়ের রস খুবই উপকারী। কারণ লাউ এর রস রক্তের শর্করার পরিমাণ কম করতে এবং রক্তচাপের ভারসাম্য ঠিক রাখতে সাহায্য করে।
লাউ এর ছাল ছাড়িয়ে ছোট ছোট করে কেটে নিয়ে তারপর ব্লেন্ডারে দিয়ে রস করে নিন। তারপর এর সঙ্গে একটু গোলমরিচ, পরিমাণ মতো নুন এবং পুদিনা পাতা ভালো করে মিশিয়ে নিন। তারপরের সঙ্গে এক চা চামচ আদা বাটা মিশিয়ে নিন আর কয়েক ফোঁটা লেবুর রস দিন। তাহলেই তৈরি হয়ে যাবে লাউ এর রস।
দৈহিক পরিশ্রম করার পর লাউয়ের রস খেলে উপকার পাওয়া যাবে। কারণ কোন দৈহিক পরিশ্রম করলে আমাদের শরীরে গ্লুকোজ এবং কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ কমে যায়। আর সেটাকে ঠিক রাখতে সাহায্য করে লাউয়ের রস।
এবার আমরা জেনে নেব লাউ এর অপকারিতার সম্পর্কে।
লাউ এর অপকারিতা:
১. লাউ এর রস যদি তেতো হয় তাহলে খাবেন না।
লাউ এর রস যদি তেতো হয়। তাহলে তা বিষাক্ত। আর ওই তেতো রস যদি খাওয়া হয় তাহলে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। লক্ষণ হতে পারে ডায়রিয়া, বমি, অস্থিরতা। রস খাওয়ার আগে পরীক্ষা করে নেবেন, স্বাদে তেতো হয়, তাহলে খাবেন না।
২. অনেক সময় লাউ খেলে অ্যালার্জি হতে পারে।
অনেকের লাউ খেলে অ্যালার্জি হতে পারে। তাই লাউ খাওয়ার পর যদি গায়ে চুলকানি বা জিভে কুটকুট, গলা চুলকানি পায়। তাহলে বুঝবেন আপনার লাউ তে অ্যালার্জি আছে। তখন আপনাকে লাউ খাওয়া থেকে দূরে থাকবেন।
৩. অতিরিক্ত লাউ খেলে রক্তচাপ হঠাৎ কমে যেতে পারে।
লাউ উচ্চ রক্তচাপ কমানোর জন্য ভালো। কিন্তু লাউয়ের রস অতিরিক্ত পান করলে, হঠাৎ রক্তচাপ কমে যেতে পারে।
৪. অতিরিক্ত লাউ খেলে রক্তে সুগারের পরিমাণ হঠাৎ কমে যেতে পারে।
লাভ রক্তের শর্করা মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। কিন্তু অতিরিক্ত লাউ খেলে রক্তের শর্করার পরিমাণ হঠাৎ করে কমে যেতে পারে।
লাউ সম্পর্কে অন্যান্য কিছু প্রশ্ন এবং তার উত্তর:
লাউ এ কি কি থাকে?
লাউ এর মধ্যে আছে ভিটামিন, শর্করা, ফ্যাট, ক্যালসিয়াম, ক্যালোরি, ফসফরাস, আয়রন, পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ইত্যাদি প্রয়োজনীয় উপাদান আছে।
লাউ গাছে কি কি সার দিতে হয়?
লাউ চাষ করার জন্য জমি তৈরি করার সময় প্রতি হেক্টর ৫০ থেকে ৬০ টন গোবর সার প্রয়োজন হয়। প্রতি হেক্টর ৫০ কেজি নাইট্রোজেন এবং ৬০ কেজি ফসফরাস দিতে হয়। প্রতি হেক্টর ৪ থেকে ৬ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়।
লাউ বিভিন্ন রকমের হয়। যেমন :
হাইব্রিড – মার্টিনা, ডায়না, বর্ষা ও তাফসি।
উফশীর মধ্যে হল – গ্রীন ডায়মন্ড, বাড়ি লাউ এবং ক্ষেত লাউ।
উপসংহার:
আমরা আজকে আমাদের এই আর্টিকেলে জেনে নিলাম লাউ খাওয়ার উপকারিতা এবং অপকারিতা সম্পর্কে বিশেষ কিছু অজানা তথ্য। লাউ খাওয়ার উপকারিতা এবং অপকারিতা – লাউ খাওয়ার উপকারিতা এবং অপকারিতা সম্পর্কে জেনে নিলাম। সব জিনিসেরই যেমন উপকারিতা আছে, তেমনি অপকারিতাও আছে। ঠিক সেই রকম লাউ খাওয়ার উপকারিতা যেমন আছে, তেমনি লাউ খাওয়ার অপকারিতাও আছে। আশা করি আপনাদের কাছে আমাদের এই আর্টিকেলটি বোধগম্য হয়েছে এবং ভালো লেগেছে। সবশেষে বলি বন্ধুরা যদি ভালো লেগে থাকে তাহলে বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করুন। আর যদি কোন প্রশ্ন থাকে তাহলে কমেন্ট করে জানান। আমাদের আর্টিকেলটি শেষ পর্যন্ত পড়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। সুস্থ থাকুন, ধন্যবাদ।