আন্তর্জাতিক ডেস্ক : দীর্ঘ ৩২ দিন জিম্মিদশায় থাকার পর অবশেষে সোমালিয়ার জলদস্যুদের কবল থেকে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ এবং জাহাজে থাকা ২৩ নাবিক মুক্ত হয়েছেন। বাংলাদেশ সময় গতকাল শনিবার দিবাগত রাত সোয়া ৩টার দিকে জাহাজটি দস্যুমুক্ত হয়।

মুক্তিপণের মাধ্যমে জাহাজ ও নাবিকরা মুক্ত হয়েছেন বলে জানিয়েছে মালিকপক্ষ। তবে কত টাকা মুক্তিপণ দেয়া হয়েছে, এ ব্যাপারে মুখ খোলেনি জাহাজটির মালিক ও বাংলাদেশ সরকারের কেউ।

তবে জাহাজের মালিকপক্ষ মুক্তিপণ নিয়ে কথা না বললেও সোমালিয়ার এক জলদস্যু সেই তথ্য প্রকাশ করেছেন বার্তা সংস্থা রয়টার্সের কাছে।

রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ ও ২৩ নাবিককে ৫ মিলিয়ন বা ৫০ লাখ ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৫৫ কোটি অর্থাৎ ৫৪ কোটি ৭৪ লাখ ৩৫ হাজার টাকা) মুক্তিপণের বিনিময়ে মুক্তি দেয়া হয়েছে।

ডেইলি সোমালিয়া জানিয়েছে, অর্থ পাওয়ার পর কিছু জলদস্যু স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল পুটল্যান্ডের উপকূলে পালিয়ে গেছে। এখন এই দস্যুদের ধরতে সামরিক অভিযান চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে সোমালিয়ার আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী।

আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, যেহেতু বাংলাদেশি জাহাজ জিম্মি করে দস্যুরা মুক্তিপণ আদায়ে সক্ষম হয়েছে। তাই অন্যান্য দস্যুরাও জাহাজ জব্দ করার মিশনে নামতে পারে।

এদিকে রয়টার্স জানিয়েছ, তারা দুই দস্যুর সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলেছে। দস্যুরা তাদের জানিয়েছে, দুইদিন আগেই মুক্তিপণের অর্থ দেয়া হয়। এরপর অর্থগুলো আসল নাকি নকল ছিল সেটি যাচাই করা শুরু করে তারা। এরপর অর্থগুলো নিজেদের মধ্যে ভাগ করে তারা পালিয়ে যান।

জাহাজের সব নাবিককে ছেড়ে দেয়া হয়েছে জানিয়ে জলদস্যু আব্দিরাশিদ ইউসুফ বলেন, দুই রাত আগে আমাদের কাছে অর্থ আনা হয়। সেগুলো জাল কি না, তা আমরা যাচাই করে দেখেছি। এরপর আমরা সেগুলো ভাগ করে নিয়ে সরকারি বাহিনী এড়িয়ে চলে যাই।

এ বিষয়ে সোমালিয়ার সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা কোনো সাড়া দেননি বলে জানায় রয়টার্স।

১৪ এপ্রিল, রবিবার দুপুর ১২টার দিকে চট্টগ্রাম নগরীর আগ্রাবাদ গোসাইলডাঙ্গায় নিজ প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনের কেএসআরএম গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেরুল করীম বলেন, আমাদের আরেকটি জাহাজ “জাহান মনি’ পণবন্দী হয়েছিল। তখন আমাদের অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে জাহাজটি মুক্ত করতে সময় লেগেছিল। তবে তখনকার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এবার আমরা দ্রুত এমভি আবদুল্লাহ মুক্ত করতে পেরেছি। জাহাজের সব নাবিক-ক্রু সুস্থ আছেন। কারও কোনো ক্ষতি হয়নি।

জাহাজ মুক্ত করার প্রক্রিয়া সম্পর্কে মেহেরুল করীম বলেন, জাহাজটি জিম্মি হওয়ার পর থেকে আমরা প্রতিনিয়ত সেটির পজিশন ট্র্যাক করতাম। কোথা থেকে কোথায় নেয়া হচ্ছে তা সার্বক্ষণিক নজরদারি করতাম।

তিনি আরও বলেন, পণবন্দির কয়েক দিন পর জলদস্যুদের একজন যিনি ইংরেজিতে কথা বলতে পারেন, তিনি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। এরপর সব আন্তর্জাতিক প্রোটোকল মেনে আমরাও আমাদের দিক থেকে যোগাযোগ শুরু করি। এভাবে টানা মাসখানেকের যোগাযোগের সফলতাতেই মুক্ত হয় এমভি আবদুল্লাহ।

মেহেরুল করীম বলেন, দুদিন আগে আমরা আমাদের জাহাজের প্রতিটি ক্রু-নাবিকের ভিডিও নিয়ে তাদের সুস্থতা নিশ্চিত করি। প্রতিটি নিয়ম মেনে কাজ করা হয়েছে। জাহাজে ৬৫ জন জলদস্যু ছিল। আজ রবিবার রাত ৩টার দিকে জাহাজের ক্যাপ্টেন আমাকে জানান জলদস্যুরা জাহাজ থেকে স্পিডবোটে করে নেমে গেছে।

সাংবাদিকেরা মেহেরুল করীমের কাছে মুক্তিপণের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ক্ষমা চাচ্ছি। কোনো মুক্তিপণের বিষয়ে আমি আপনাদের কিছু বলতে পারব না। সবার সঙ্গে আমাদের এই বিষয় নিয়ে এগ্রিমেন্ট হয়েছে। আমি এগ্রিমেন্টের বাইরে যেতে পারব না।

জাহাজটির মালিকপক্ষ কবির গ্রুপের মুখপাত্র মিজানুল ইসলাম জানান, উদ্ধার হওয়া জাহাজ ‘এমভি আবদুল্লাহ’ দুবাই যাবে। সেখানে ওই জাহাজে যোগ দেবেন নতুন নাবিকরা। মুক্ত হওয়া ২৩ নাবিককে বিমানে চট্টগ্রামে নেওয়া হবে। চট্টগ্রামে পৌঁছানের পর কিছু আনুষ্ঠানিকতা শেষে তারা স্বজনদের কাছে ফিরবেন।

মিজানুল ইসলাম আরও জানান, ঈদের আগেই নাবিকদের ফিরিয়ে আনার কথা ছিল। কিন্তু কিছু জটিলতায় সময় পরিবর্তন হয়। অতীতে জাহান মণির অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে দ্রুত সময়ে ২৩ নাবিককে মুক্ত করা সম্ভব হয়েছে।

প্রসঙ্গত, গত ১২ মার্চ মোজাম্বিক থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতে কয়লা নিয়ে যাওয়ার পথে ভারত মহাসাগরে সোমালি দস্যুদের কবলে পড়ে বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ। এটির মালিক কবির রি রোলিং মিলস। ওই সময় জাহাজটিতে ২৩ নাবিক ছিলেন।

তাদের ছাড়িয়ে আনতে ভারতীয় নৌবাহিনী সামরিক অভিযান চালানোর প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু নাবিকদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে এতে সম্মতি দেয়নি বাংলাদেশ সরকার।

এর বদলে আলোচনার মাধ্যমে নাবিকদের ফিরিয়ে আনার পথ অনুসরণ করা হয়। এতে করে সব নাবিককে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।