আসাদুজ্জামান আসাদ।। সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে ঢাকার আন্দোলনে যোগ দিয়ে সংঘর্ষে নিহত ইমতিয়াজ আহমেদ জাবির (২৩) যশোরের ঝিকরগাছার দেউলি গ্রামে দাফন সম্পন্ন হয়েছে।

শুক্রবার রাতে ঝিকরগাছা উপজেলার দেউলি গ্রামের আতিয়ার রহমান খান হাফিজিয়া মাদ্রাসা প্রাঙ্গনে তার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।

শোকে স্তব্ধ গোটা এলাকা। স্বজন হারানোর ব্যাথায় চরমভাবে ব্যাথিত এলাকাবাসী। ব্যাপক সম্ভাবনাময় একটি তাজা প্রাণ ছাত্র অধিকারের পক্ষে রাজপথে নেমে লাশ হয়ে ফিরবে সেটা কেউ মেনে নিতে পারছেন না। সন্তানের লাশ পিতার কাঁধে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বোঝা -সেই বোঝা কাঁধে করে দুই নয়নের জলে হৃদয় ভাসিয়ে একমাত্র পুত্রের লাশ নিয়ে ফিরছেন ঢাকা মেডিকেল থেকে কৃষক নওশের আলী।
সাথে তার স্ত্রী শিরিনা বেগম ও একমাত্র মেয়ে জেরিন রয়েছে। এই পথ যেন শেষ হয়েও হচ্ছে না। ঢাকা মেডিকেল মর্গের সামনে হাজারও শোকাহত পরিবারের একটি নওশের আলীর পরিবার। এই পরিবারের একমাত্র পুত্র সন্তান জাবির। যে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন বীর শহীদ।

যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার হাজিরবাগ ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের একটি গ্রাম দেউলী। এই গ্রামের এক মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারের সন্তান ইমতিয়াজ আহমেদ জাবির (২৩)। কৃষক নওশের আলী ও গৃহিনী শিরিনা আক্তার দম্পত্তির ২ সন্তানের মধ্যে জাবির বড়। ছোট মেয়ে জেনির স্থানীয় বাগআঁচড়া ডা. আফিল উদ্দিন ডিগ্রি কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের প্রথম বর্ষের ছাত্রী।

জাবির ২০১৮ সালে বাগআঁচড়া হাই স্কুল থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে নাভারণ আকিজ কলিজিয়েটস্কুল এন্ড কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে (আইএ) ভর্তি হন। এই কলেজ থেকে মানবিক বিভাগের ছাত্র হিসেবে জিপিএ-৫ পেয়ে ২০২১ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়। জাবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ না পেয়ে ২০২১-২২ শিক্ষা বর্ষে ঢাকার সাউথইস্ট ইউনির্ভাসিটিতে বিবিএ কোর্সে ভর্তি হন।

পিতা মাতার স্বপ্ন ছিলো তাদের একমাত্র সন্তান বড় হয়ে লেখাপড়া শিখে দেশ ও দশের মুখ উজ্জল করবে। পরিবারের হাল ধরবে। কৃষক পিতা নওশের আলী স্বপ্ন দেখতেন তার ছেলে মানুষের মতো মানুষ হয়ে এলাকাবাসীর ও পিতা হিসেবে তার মুখ সে উজ্জল করবে। ছেলের গর্বে পিতার বুক ভরে উঠবে। কিন্তু হায় ! আজ সেই ছেলের লাশ কাঁধে করে ঢাকা থেকে ফিরতে হচ্ছে এক বুক জ্বালা ব্যাথা আর বেদনা নিয়ে। যে সন্তান এক সপ্তাহ আগেও পিতার সাথে ফোনে কথা বলেছিল, কত স্বপ্নের কথা, আশার কথা, ভালোবাসার কথা বলে সে বাবাকে শান্তনা দিয়েছি।

জাবির বলেছিল, বাবা ভয় নেই জয় আমাদের হবেই। তোমার ছেলে একা নয় বাবা, দেশের লাখো কোটি পরিবারের ছেলেরা আজ রাজপথে নেমেছে তাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য। লাখো লাখো শিক্ষার্থীর সেই আন্দোলন বৃথা যাবে না বাবা। তুমি শুধু শুধু ভয় পাচ্ছ বাবা । দেখো তোমার ছেলের কিছুই হবে না। মাকে কে বলো আমার জন্য দোয়া করতে। আর ছোট বোন জেরিনের দিকে খেয়াল রেখ বাবা। বাবা রাখছি, বন্ধুরা আন্দোলনে যেতে ডাকছে। যাই বাবা , ভালো থেকো। এই পিতা পুত্রের শেষ কথা।

আর কোন দিন ছেলে তার বাপকে ডাকবে না। ঢাকা থেকে কোন দিন আর ফোন করে বলবে না বাবা আমার টাকা লাগবে। বই কিনতে হবে। মেসে খাবারের টাকা দিতে হবে। মাকে আর বলবে না , মা আমি বাড়ি আসছি তুমি একটা দেশি মুগরী রান্না করে সিট রুটি বানাও। আমি এসে খাব। আদরের ছোট বোন জেরিনকে আর ধমক দিয়ে পড়ার টেবিলে বসতে বলবে না। তোকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হবে বলে আর কেউ স্বপ্ন দেখাবে না।এক নিশ্বাসে এই কথা গুলো বলে অঝোরে কাঁদতে লাগলেন সন্তান হারা পিতা কৃষক নওশের আলী।

মোবাইল ফোনে শুক্রবার বিকেলে যখন এই প্রতিবেদক নওশের আলীর সাথে কথা বলছিলেন তখন হাজারও মা বাবার সাথে নওশের আলী দম্পত্তি একমাত্র মেয়ে জেরিনকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেলের মর্গের সামনে বসে ছিলেন ছেলের লাশ গ্রহণ করার জন্য।

ইমতিয়াজ আহমেদ জাবির অত্যন্ত একজন মেধাবী ছাত্র। ছাত্র জীবনে সে কোন ক্লাসে প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় হয়নি। কৃষক নওশের আলী বা তার পরিবারের কেউ কোন দিন কোন রাজনীতির সাথে জড়িত নয়। জাবির নিজেও কোন দিন রাজনীতির পাঠে হাতে খড়ি নেননি। শুধু নিজের অধিকার রক্ষার জন্য, ছাত্রদের অধিকার আদায়ের জন্য দেশে চলমান কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়ে নিজেদের অধিকার ও মর্যাদা তথা মেধা পরীক্ষার দাবিতে রাজপথে নেমেছিলেন। কিন্তু দেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্মম বুলেটে শহীদ হলেন মেধাবী ছাত্র ইমতিয়াজ আহমেদ জাবির।

নওশের আলী বলেন,বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রাজপথে লড়াই সংগ্রাম করার সময় ১৭ জুলাই সাউথইষ্ট ভার্সিটির ক্যাম্পাসের সামনের রাস্তায় পুলিশের গুলিতে আহত হন জাবিরসহ তার কয়েকজন সহপাঠী। ওই দিনই বিকেলে গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করা হয়। শত শত গুলিবিদ্ধ আর আহত শিক্ষার্থীর সাথে জাবিরও চিকিৎসা নিচ্ছিলেন ঢাকা মেডিকেলে। মোবাইল ফোনে বার বার ছেলের সাথে যোগাযোগ করেও কোন খোঁজখবর পাচ্ছিলাম না।শেষ পর্যন্ত ২৪ জুলাই জানতে পারি জাবির গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি আছে।

খবর পাওয়া মাত্রই একমাত্র মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে নওশের আলী দম্পত্তি ঢাকা মেডিকেলে ছুটে যান।কিন্তু তাকে ছেলের কাছে যেতে বাঁধা দিয়েছেন পুলিশ ও বিজিরি সদস্যরা।

নওশের বলেন, বার বার আমরা ছেলের কাছে যাওয়ার অনুরোধ করেও ব্যর্থ হয়েছি। দুই রাত আর একদিন মেডিকেলের গেটে বসে থেকে জাবিরের এক সহপাঠীর সহযোগিতায় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ছেলের কাছে আমরা পৌঁছাতে পারি। ততক্ষনে ছেলে কোমায় চলে গেছে। বার বার ছেলেকে ডেকেও শেষ কথাটি শুনতে পায়নি। তারপরও বুকে আশা নিয়ে ছেলের কাছে ছিলাম। কিন্তু আজ শুক্রবার সকালে সবাইকে শোক সাগরে ভাসিয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমায় আমাদের আশা ভরসার শেষ প্রদীপ জাবির।

বিকাল পৌনে ৫টায় নওশের আলী জানান, মেডিকেলের আনুষ্ঠানিকতা শেষে মরদেহ আমাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ্যাম্বুলেন্সে করে নিহত সন্তানের লাশ নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছি। নওশের আলীর সাথে তার ছেলের কয়েকজন সহপাঠী ও ২ জন শিক্ষকও রয়েছেন বলে তিনি জানান।

নওশের আলী কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলেন, ভাই আমার সব শেষ হয়ে গেল। এই পৃথিবীতে আমার আর বেঁচে থাকার ইচ্ছা নেই। কি হবে এই দেশে বেঁচে থেকে। যে সন্তানকে খুব কষ্ট করে,খেয়ে না খেয়ে বড় করে লেখাপড়ার জন্য ঢাকায় পাঠিয়েছিলাম সেই ছেলের লাশ নিয়ে আজ আমাকে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে। কি জবাব দেব আমি এলাকাবাসীকে। যারা আমার ছেলেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতো, গর্ব করতো তাদের আমি কি জবাব দেব বলতে পারেন সাংবাদিক সাহেব?