বিশেষ সংবাদ | তারিখঃ আগস্ট ২৬, ২০২৪ | নিউজ টি পড়া হয়েছেঃ 3873 বার
গ্রামের সংবাদ ডেস্ক : সংবিধান সংশোধন ♦ প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠন ♦ আইনকানুন যুগোপযোগী করা ♦ ব্যক্তির পরিবর্তন ♦ দুর্নীতিবাজদের শাস্তি ♦ রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন ।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। গোলাম রাব্বানী
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য সংবিধানে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। তিনি রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ছয়টি বিষয়ে নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদকে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, আইনকানুনগুলো যুগোপযোগী করতে হবে। ব্যক্তির পরিবর্তনের পাশাপাশি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠন করতে হবে। দুর্নীতিবাজদের শাস্তি দেওয়ার মাধ্যমে দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের অবসান ঘটাতে হবে। নিয়মকানুন, বিধি বিধানে এমন পরিবর্তন আনতে হবে যাতে আবার দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের পুনরাবৃত্তি না ঘটে। সর্বোপরি রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনার পরামর্শ দিয়েছেন এ নির্বাচন বিশ্লেষক।
তিনি বলেছেন, রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন উপদেশ-আদেশ দিয়ে করা যাবে না। এটা রাজনীতিবিদদের ওপর নির্ভর করবে। রাজনীতিবিদদের উপলব্ধিতে আসতে হবে-যা ঘটেছে এটা কারও জন্য কল্যাণকর নয়। অতীতে আমরা রাজনীতিবিদদের কাছে যা পেয়েছি, তা আমাদের আশাবাদী করে না। রাষ্ট্র সংস্কার, সংবিধান সংশোধনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পুনর্গঠন নিয়ে গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে একান্ত আলাপকালে সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার এসব কথা বলেছেন।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ নিয়ে চলছে নানামুখী আলোচনা। কেমন হওয়া উচিত আগামীর বাংলাদেশ, উঠেছে সে প্রশ্ন। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক। আগামীতে দেশ গণতান্ত্রিক ধারায় এগিয়ে নিতে কী কী সংস্কার প্রয়োজন তা নিয়ে চলছে আলাপ-আলোচনা।
সুজন সম্পাদক বলেন, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমরা ১৯৭১ সালে স্বাধীন হয়েছি। আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে ছিল আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা; ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা করা এবং সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু তা থেকে আমরা যোজন যোজন দূরে। আমরা একটা পথ হারানো জাতিতে পরিণত হয়েছি। আমাদের একাত্তরের আকাক্সক্ষা বাস্তবায়িত হয়নি। নব্বইয়ের তিন জোটের রূপরেখা বাস্তবায়িত হয়নি।
২০০৮ সালের দিনবদলের সনদে সুস্পষ্ট অঙ্গীকার ছিল। সেগুলোও বাস্তবায়িত হয়নি। শুনেছি, ২০০৭ সালে রাজনীতিবিদরা যখন একসঙ্গে অনেকেই জেলখানায় ছিলেন তখন তাঁদের উপলব্ধি হয়েছিল-যে কারণে ১/১১ সৃষ্টি হয়েছিল তার যেন আর পুনরাবৃত্তি না ঘটে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেই কথাও তাঁরা রাখেননি। আসলে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি হচ্ছে কথা না রাখার সংস্কৃতি। জনস্বার্থের পরিবর্তে নিজের স্বার্থ, ব্যক্তিস্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থ চরিতার্থ করার সংস্কৃতি। এসব পরিবর্তন করতে রাজনীতিবিদদের এগিয়ে আসতে হবে।
তিনি বলেন, গত ১৫ বছরে বিএনপির নেতা-কর্মীরা বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড, আয়নাঘর, গুম, হাজার হাজার গায়েবি মামলাসহ অনেক কিছুই ঘটেছে। নাগরিকসমাজের কর্মপরিধি সংকুচিত করা হয়েছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতাও সংকুচিত করা হয়েছে বিভিন্ন আইনের মাধ্যমে। এসব পরিবর্তন করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে।
নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রত্যাশা কী-জানতে চাইলে সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আমার প্রত্যাশা আর জনগণের প্রত্যাশা দুইটাই এক। এ গণ আন্দোলনের সময় যেটা শুনেছি মানুষের মুখ থেকে, সেটা হলো রাষ্ট্র মেরামত করতে হবে। আমার রাষ্ট্রটা ভঙ্গুর অবস্থায় আছে। প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। আমাদের অদক্ষ-অযোগ্যদের রাজত্ব কায়েম হয়েছে। দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ এবং আমরা একটা দুর্বৃত্তায়িত রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছি। আমাদের কোনো রাষ্ট্রীয় বাহিনী ছিল না। সব দলীয় বাহিনীতে পরিণত হয়েছে।
তিনি বলেন, মোটা দাগে বলতে গেলে আন্দোলনের সময় আমি যে বার্তা পেয়েছি সেটা হলো, যারা অন্যায় করেছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত। তিন ধরনের অন্যায় হয়েছে (ক) একটা হলো মানবতাবিরোধী অপরাধ; বহু ব্যক্তি হতাহত হয়েছে অকারণে; অহেতুক। এর বিচার হওয়া উচিত, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত। (খ) আরেকটা হলো ফৌজদারি ও দেওয়ানি অপরাধ। প্রথমত ফৌজদারি অপরাধ-এই যে আয়নাঘর, খুন-গুম, মানুষের বিভিন্ন ধরনের হয়রানি; বিচারহীনতা এ ধরনের ফৌজদারি অনেক অপরাধ হয়েছে। এগুলোর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত। দ্বিতীয়ত দেওয়ানি অপরাধ। যেমন ব্যাংক লুট, দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন, অর্থ পাচার হয়েছে। এগুলো হলো মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে নেওয়া। এসব অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া দরকার। এ শাস্তির আগে একটা সুষ্ঠু নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়ার প্রয়োজন। যেটা আশা করি শুরু হচ্ছে জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিনিধি আসার মাধ্যমে; এটা হলো একটা বার্তা। আরেকটা হলো (গ) আমাদের রাষ্ট্র ভেঙে পড়েছে। আমাদের সংবিধান আর কার্যকর নয়। আমাদের অনেক আইন আছে, যা ব্যক্তিস্বার্থে, গোষ্ঠীস্বার্থে পরিণত হয়েছে। আইনগুলো জনস্বার্থে প্রয়োগ করা হয়নি। আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো কবজিভূত করা হয়েছে। দলীয় স্বার্থে এবং ব্যক্তিস্বার্থে এগুলো পরিচালিত হয়েছে। পুলিশ হলো রাষ্ট্রীয় বাহিনী। কিন্তু তা দলীয় বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। আমাদের প্রশাসনিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এগুলো কার্যকরের জন্য কিছু সুদূরপ্রসারী সংস্কার দরকার। সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন দরকার। এজন্য প্রক্রিয়া; ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তন দরকার। একই সঙ্গে সাংবিধানিক পরিবর্তন দরকার; আইনকানুনের পরিবর্তন দরকার। এসব করা গেলে একটা রাষ্ট্র মেরামতের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
রাষ্ট্র মেরামতের জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কী কী করা প্রয়োজন-জানতে চাইলে তিনি বলেন, কতগুলো কাজ তারা (অন্তর্বর্তী সরকার) শুরু করেছে। যেমন তারা কিছু ব্যক্তিকে বিদায় করছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কতগুলো ব্যক্তি বসে আছেন। যারা চরম দুর্নীতিগ্রস্ত, চরম পক্ষপাতদুষ্ট এবং তারা অযোগ্য বহুলাংশে। তারা জনস্বার্থের পরিবর্তে ব্যক্তিস্বার্থে কাজ করেছেন। সেসব ব্যক্তিকে বিদায় করার কাজ শুরু হয়েছে। এসব ব্যক্তিকে বিদায় করার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠন করতে হবে। পুনর্গঠন করতে হলে দেখতে হবে যেসব আইনকানুন আছে তা সঠিক কি না। সঠিক না থাকলে তা পরিবর্ধন-পরিমার্জন করতে হবে।
তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইন যেটা করা হয়েছে ২০২২ সালে, এটা কোনো আইন হয়নি। আগের প্রজ্ঞাপনটাই আইনের মোড়কে প্রকাশ করেছে। এটাতে শুধু একটা দায়মুক্তির বিধান যুক্ত করা হয়েছে। তাই এ আইনটা পরিবর্তন করা দরকার এবং সে পদ্ধতি অনুসরণ করে নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। তার পরে এ প্রতিষ্ঠানগুলোয় যে সংস্কৃতির সৃষ্টি হয়েছে তা পরিবর্তন করা দুরূহ। তবে দলীয় স্বার্থ ও ব্যক্তিস্বার্থ রক্ষা করার বিষয়গুলো পরিবর্তন করতে হবে। আইনকানুন, প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির পরিবর্তন দরকার।
সুজন সম্পাদক বলেন, সংবিধানে কতগুলো পরিবর্তন আনা দরকার। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ছিল রাজনৈতিক সমঝোতার প্রতিফলন। আওয়ামী লীগ দাবি করেছে। গণ আন্দোলন গড়ে তুলেছে। বিএনপি প্রথম দিকে এটা মেনে না নিলেও শেষ পর্যন্ত একটা একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে সংবিধানে তা (তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা) অন্তর্ভুক্ত করে তারা পদত্যাগ করেছে। এটা একটা রাজনৈতিক সমঝোতা ছিল। কিন্তু সেটাও বাতিল করা হয়েছে। এ ব্যাপারে দুই দলের দায় আছে। যদিও আওয়ামী লীগ সম্পূর্ণ অসাংবিধানিকভাবে এটা সংশোধন করে পঞ্চদশ সংশোধন পাস করেছে। এগুলো গভীরভাবে দেখা দরকার এবং সংবিধানে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন।
তিনি বলেন, সংবিধানের পরিবর্তন আমরা দুইভাবে আনতে পারি। এক. পুরো সংবিধান বাদ দিয়ে আমরা নতুন করে সংবিধান রচনা করতে পারি। তবে এটা সহজ নয়, দুরূহ এবং সময়সাপেক্ষ বিষয়। দুই. এ সংবিধানের কতগুলো বিষয়ে সুদূরপ্রসারী গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে পারি। যেমন নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা কেমন হবে। আমাদের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সক্ষমতার ভারসাম্য। ৭০ অনুচ্ছেদসহ আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিবর্তন আনতে হবে। এসব বিষয় ভাবতে হবে। কতগুলো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে উপদেষ্টা পরিষদকে। মূলত নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় এ রাষ্ট্র মেরামতের স্লোগান তুলেছিল আমাদের তরুণরা। তবে এ বিষয়টা আমরা একেকজন একেকভাবে বুঝি। যাঁরা দায়িত্বে আছেন তাঁরা যদি সংজ্ঞায়িত করেন তাঁরা কতটুকু যেতে পারেন, তাঁরা কী কী করবেন, তাহলে আমরা সুস্পষ্টভাবে সহায়তা করতে পারি।
তিনি বলেন, সংবিধানে কতগুলো ভয়াবহ বিষয় রয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো, ৭ক অনুচ্ছেদ। পঞ্চদশ সংশোধনের মাধ্যমে যা সংযুক্ত করা হয়েছে। এ বিধান যদি বাতিল না হয়, তবে প্রধান উপদেষ্টা থেকে শুরু করে যাঁরা আমরা সংবিধান পরিবর্তনের কথা বলছি তাঁদের সবাইকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলতে হবে। সবাইকে কিন্তু রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হবে।
সংসদ ভেঙে দেওয়ার পর সংসদ নির্বাচন বিষয়ে তিনি বলেন, এখন একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি। যেমন বিচারপতি মতিন বলেছেন-আমাদের গণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সবকিছু নতুন করে তৈরি করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। অতীতের কিছুরই আর অস্তিত্ব নেই। আমাদের উপদেষ্টা পরিষদ যদি সেভাবে অবস্থান নেন, তবেই সবকিছু সম্ভব। এ বিষয়ে উপদেষ্টা পরিষদকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এজন্য প্রয়োজন হবে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সহযোগিতা। তাঁরা যদি অসহযোগিতা করেন তবে হবে না। এসব বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ার ক্ষেত্রে উপদেষ্টা পরিষদ নাগরিক সংলাপ করতে পারে; বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে আলাপ করতে পারে। ব্যক্তিগতভাবে আলাপ করতে পারে। তারা ইতোমধ্যে বসেছে। তবে এটা সময়সাপেক্ষ। তারা আলাপ-আলোচনা করে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছা দরকার।
রাষ্ট্র সংস্কারের বিষয়ে কতদিন লাগতে পারে-এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, সংস্কার করতে কতদিন লাগবে তা কাজের ওপর নির্ভর করবে এবং কতদিন দিতে রাজনৈতিক দলগুলো রাজি হবে। আমি মনে করি, কতদিন প্রয়োজন তারা যেন সুস্পষ্ট করেন। মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার শেষ নেই। আকাশচুম্বী আকাক্সক্ষা মানুষের। মানুষ চায় আর যেন আমরা অতীতে ফিরে না যাই। ভয়ানক কর্তৃত্ববাদী সরকার যেন আবার আমাদের ওপর নাজিল না হয়।
এ বিশ্লেষক বলেন, অতীতে চারটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার সৃষ্টি হয়েছিল। তখন অনেক কাজ সহজ ছিল। তখন প্রশাসন কার্যকর ছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবারের মতো ভেঙে পড়েনি। তাদের কাজগুলো ছিল রুটিন। তাদের নীতিগত কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা নয়। কিন্তু এখন তাদের অনেক সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যদিও কাজটা অনেক জটিল ও কষ্টকর।
স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে প্রশাসক নিয়োগ ও পরবর্তী নির্বাচন বিষয়ে তিনি বলেন, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে পরিচালিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। এখন প্রশাসক নিয়োগ করা হয়েছে। এখন আমাদের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোয় নির্বাচন দেওয়ার দিকে হাঁটতে হবে। নির্বাচনের আগে আমাদের আইনকানুনগুলো দেখতে হবে। স্থানীয় সরকারের অনেক আইনকানুন আছে। তা অনেক ক্ষেত্রে সঠিক নয়। যেমন জেলা পরিষদের আইন। সাবেক একজন অর্থমন্ত্রীও এ আইনটাকে অথর্ব বলেছেন।
তিনি বলেন, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী ও গতিশীল করার জন্য ২০০৭ সালে একটি কমিটি হয়েছিল। ওই কমিটির সদস্য আমিও ছিলাম। ওই কমিটির পক্ষ থেকে আমরা সব আইন রিরাইট করেছি। অধ্যাদেশও হয়েছিল। কিন্তু পরে তা প্রথম অধিবেশনে অনুমোদন হয়নি। সরকার দুই ভাবে আইন সংস্কার করতে পারে। এক. আইন সংস্কারে একটা কমিটি করতে পারে। দুই. বিগত কমিটির আইনের খসড়া রয়েছে। ওই আইনগুলো আবারও নতুন করে পর্যালোচনা করে অধ্যাদেশ আকারে জারি করে নির্বাচনের দিকে যাওয়া দরকার।
নির্বাচন কমিশনের নিয়োগ আইনের বিষয়ে তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন নিয়োগে যে আইন করা হয়েছে, সেটা কোনো আইন হয়নি। আমরা একটা খসড়া তৈরি করেছি। আগামী ২৯ আগস্ট আমরা খসড়া আইন তুলে ধরব। আলোচনা করব। এ ছাড়া নির্বাচনের হলফনামা দেওয়ার যে ছক রয়েছে তা-ও এখন উপযোগী নয়। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) কী কী সংস্কার দরকার সে বিষয়েও কিছু প্রস্তাব তুলে ধরব। পরে আলাপ-আলোচনা শেষে এসব বিষয় আমরা উপদেষ্টা পরিষদের কাছে উপস্থাপন করব।
সংসদ নির্বাচন আগে নাকি স্থানীয় নির্বাচন-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে হওয়া উচিত। যারা নির্বাচন কমিশন আসবে স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন হবে। যতদ্রত সম্ভব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন দেওয়া উচিত। অনির্বাচিত ব্যক্তিদ্বারা স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হওয়া উচিত নয়।
কতদিনের মধ্যে সংসদ নির্বাচন প্রত্যাশা করেন-জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা বলা দুরূহ। আমরা কতটুকু যেতে চাই, তার ওপর এ সময় নির্ভর করবে। আমরা আশা করি আমাদের কাজ আমরা করছি। আমরা সহযোগিতা করছি।
মিডিয়ার ওপর হামলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা বন্ধ হওয়া দরকার। আসলে আমাদের মিডিয়া সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেনি। কেউ কেউ চাপে পড়ে দায়িত্ব পালন করতে পারেনি। কেউ অতি উৎসাহী হয়ে কাজ করেছে। মিডিয়ার সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনা দরকার।
তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চা জরুরি। বিগত সরকার ২০০৮ সালে নির্বাচনের আগে নির্বাচনি ইশতেহার প্রকাশ করেছিল। শিরোনাম ছিল ‘দিনবদলের সনদ’। তারা সেখানে অনেক কিছু পরিবর্তন করার কথা বলছিল। বলেছিল, সবকিছু আমূল পরিবর্তন করবে। তবে দিনবদল হয়েছে, কিন্তু দিন থেকে রাত হয়েছে। কিছুই বাস্তবায়ন করেনি। তখন একজন বিচারক বলেছিলেন, দেশটা বাজিকরদের হাতে। এসব হওয়ার বড় কারণ হলো আমাদের নির্বাচনব্যবস্থাটা ভেঙে দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনের মাধ্যমে দায়বদ্ধতা সৃষ্টি হয়। যেমন একটা দলকে পাঁচ বছর পর পর জনগণের কাছে এসে ভোটভিক্ষা করতে হয়। জনগণের যদি সুযোগ থাকে লাল কার্ড দেখানোর, তাহলে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা, সুখদুখকে গুরুত্ব দিতে হবে। তাদের দায়বদ্ধ হতে হবে। নির্বাচনের মাধ্যমে যদি সংসদ প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে সমান্তরাল দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে ভোটের অধিকার যখন হরণ করা হয়, তখন যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারে এবং তা-ই হয়েছে। তারা জনগণের স্বার্থ দেখার পরিবর্তে যারা তাদের ক্ষমতায় রেখেছে, ক্ষমতায় এনেছে, ক্ষমতা টিকিয়ে রেখেছে এবং যারা তাদের স্বার্থসিদ্ধি করেছে তাদের স্বার্থই দেখে। কতগুলো দুর্নীতিবাজের স্বার্থই তারা দেখেছে। এজন্য নির্বাচনব্যবস্থাটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য পঞ্চদশ সংশোধন পাস করেছে। যাতে তারা ক্ষমতায় থাকাকালে তাদের অধীনেই নির্বাচন হয়। দলীয় প্রশাসন, দলীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের নির্বাচিত হওয়া নিশ্চিত করে। তারা তাদের স্বার্থই দেখেছে। পুলিশ বাহিনীকে দলীয় বাহিনীতে পরিণত করেছে। তারা রাজনৈতিক সংস্কৃতি এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছে। সরকার ও দলের মধ্যে কোনো তফাত ছিল না। দলের স্বার্থেই সরকার পরিচালিত হয়েছে। যার কারণে দলের মধ্যে কোনো শৃঙ্খলা ছিল না। এক ব্যক্তির কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
তিনি বলেন, একটি রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক হতে পারে না যদি দলের মধ্যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত না থাকে। কারণ রাজনৈতিক দল অপরিহার্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন স্বাধীনতা অর্জন করে তখন তাদের নেতৃবৃন্দ ঠিক করেছিলেন রাজনৈতিক দলের দরকার নেই। রাজনৈতিক দল হানাহানির সৃষ্টি করে। মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে। কিন্তু কালের বিবর্তনে দেখা গেছে, রাজনৈতিক দল ছাড়া কোনো উপায় নেই। কিন্তু সেই রাজনৈতিক দলগুলোকে গণতান্ত্রিক হতে হবে। স্বচ্ছ হতে হবে। দায়বদ্ধ হতে হবে এবং মানুষের কল্যাণে তাদের কাজ করতে হবে। আমাদের দেশে যত বড় বড় অন্যায় হয়েছে, সব কিন্তু রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় হয়েছে। দুর্নীতি হয়েছে আঁতাতের মাধ্যমে। রাজনৈতিক দল, একশ্রেণির রাজনীতিবিদ, আমলা এবং একশ্রেণির ব্যবসায়ীর আঁতাতে দুর্নীতি হয়েছে। এ ছাড়া প্রহসনের নির্বাচনেও আঁতাত হয়েছে। ২০১৮ সালে সরকারদলীয় একশ্রেণির নেতা-কর্মী, প্রশাসনের কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অধিকাংশ সদস্য এবং নির্বাচন কমিশনের প্রচ্ছন্ন সহায়তায় মধ্যরাতে ভোট হয়েছে। সুত্র: দৈনিক বাংলাদেশ প্রতি