বিশেষ প্রতিনিধি : নাভারনসহ সমগ্র শার্শায় চলছে মাদকের রমরমা বাণিজ্য। উপজেলার প্রধান শহর গুলি থেকে গ্রাম-মহল্লায় সর্বত্র মাদকের ছড়াছড়ি। কোন ধরনের রাখঢাক নেই, প্রকাশ্যেই মুড়ি-মুড়কির মতো খোলা বাজারে কেনা-বেচা হচ্ছে।

জানা গেছে, মাদকের সহজলভ্যতার কারণে এখন কিশোর ও তরুণরা আশঙ্কাজনক হারে মাদক সেবনে জড়িয়ে পড়ছে । মাদক ব্যবসায়ী চক্রও দিন দিন বেপরোয়া হয়ে ওঠছে। এদের দমন করতে পারছে না আইনশৃংখলা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থার কর্মকর্তারা। মাদক সেবীদের হাতে প্রতিনিয়ত ছুরিকাঘাতসহ প্রহৃত হচ্ছে এলাকার শান্তি প্রিয় মানুষ। মাদকবিরোধী অভিযান ধীরগতির কারনে গ্রাম-মহল্লায় ছড়িয়ে পড়েছে আশঙ্খাজনক হারে। তারপরেও মাদক ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করতে কঠোর কোন পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না। বরং দিন দিন মাদক ব্যবসার বিস্তার ঘটছে।

র‌্যাব-পুলিশের অভিযানে শার্শার বিভিন্ন এলাকা থেকে অল্প-সল্প ইয়াবা, ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক উদ্ধার হলেও তারপরেও বন্ধ হয়নি ইয়াবাসহ ভিন্ন ভিন্ন মাদকের ব্যবসা । অবাধে সীমান্তের ওপার থেকে আসছে ইয়াবা, ফেন্সিডিলসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক। রাজনৈতিক দলের নামীদামী নেতারা পর্যন্ত মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে। রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীদের প্রত্যেক্ষ ও পরোক্ষ মদদের কারণেই বন্ধ হচ্ছে না মাদক ব্যবসা। এমনটি জানিয়েছেন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তা।

নাভারনের একাধিক সুত্র জানান, শার্শার দক্ষিন বুরুজ বাগান গ্রামের মাদকের আড়তদার খ্যাত জয়নাল সরদার আটকের পর সচেতন মহল স্বস্তির নিশ্বাষ ফেলেছিল। তারা ভেবেছিল এবার হয়তবা এলাকা হতে মাদকের নিস্পত্তি হবে। কিন্ত তার উল্টো টা হচ্ছে। এক ডজনের বেশি মামলা নিয়ে জয়নাল আটক হওয়ার পর বর্তমানে মাদকের ব্যবসার হাত বদল হয়েছে একাধিক জনের হাতে। ছড়িয়ে পড়েছে এলাকাব্যাপী । এতে করে আগের তুলনায় বহু গুনে তরুন-যুবারা মাদকাশক্ত হয়ে পড়েছে।

গ্রামের একাধিক ব্যক্তি জানান, জয়নাল সরদার ও আয়নাল সরদার এলাকার শীর্ষ মাদক কারবারী হলেও তাদেরকে টপকিয়ে হঠাৎ গজিয়ে উঠেছে মাছুম নামের এক কিশোর। ইতিমধ্যে সে ফকির থেকে কোটিপতি বনে গেছে। আর এ ব্যবসাকে আড়াল করতে গাভি পালনসহ বিভিন্ন ব্যবসা হঠাৎ গজিয়ে তুলেছে ।

সুত্র জানান, জয়নাল সরদার ও আয়নাল সরদারের মাদকের বাহক হিসাবে মাছুম কাজ করলেও সে এখন মাদকের আড়ৎদার বনে গেছেন। তার মাদকের ব্যবসার গতি বাড়াতে দলে ভিড়িয়েছে শার্শার কুখ্যাত বোমাবাজ রবিকে । যার নামে রয়েছে ডজন খানেকের বেশি মামলা। ইতিমধ্যে কয়েকবার অস্ত্র গুলি নিয়ে পুলিশের হাতে আটক হয়েছে বোমাবাজ রবি। রবি ছিলেন শার্শার লক্ষনপুর এলাকার কুক্ষাত সন্ত্রাসী ও বিএনপি কর্মী। ২০০৮ সালে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসার পর এলাকা ত্যাগ করে উপজেলা বিএনপির সাধারন সম্পাদক আবুল হাচান জহিরের হাত ধরে দক্ষিন বুরুজ বাগান গ্রামে আশ্রয় নেয়। পরে সেখানে বাড়ি তৈরী করে স্থায়ী নিবাশী বনে যান এবং মাদক ব্যবসার সাথে জড়িয়ে পড়ে। অবশ্য পরবর্তীতে বিএনপির অপর গ্রুপ মফিকুল হাসান তৃপ্তির দলে ভিড়েছে রবি । এছাড়া এ দলের অন্যতম সদস্য হলো মন্টু।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শার্শার নাভারনে ২০/২২টি মাদক কেনা বেচার স্পট রয়েছে। শুধু পুরুষ নয়, এখন মাদক বাণিজ্যে এগিয়ে আছেন নারীরাও। দাপুটে মাদক সম্রাজ্ঞীরাই চালাচ্ছেন এখানকার মাদক স্পট। তাদের নিয়ন্ত্রণে অন্তত ২০ জন মহিলা এখন পেশাদার মাদক ব্যবসায়ী হয়ে উঠেছেন। নাভারন ও তার আশপাশের এলাকা মাদক ব্যবসায়ীদের সবচেয়ে নিরাপদ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। দক্ষিন বুরুজ বাগান গ্রামের আলোচিত মাদক সম্রাজ্ঞী রওশনারা আর রেল বস্তির গেদির মাদক সাম্রাজ্য বল্গাহীন।

সম্প্রতি তাদের মাদক ব্যবসার প্রতিবাদ করতে গিয়ে ছুরিকাঘাত হয় যুবদলের কর্মী মফিজুর রহমান। এ ঘটনার প্রতিবাদ এলাকাবাসী করায় ১০জুন রাত ৮টার পর থেকে মাদক ব্যবসায়ী ও তার দোষররা গ্রামে বৃষ্টির মত বোমার বিষ্ফোরন ঘটায়। অথচ মামলার আসামী হয় গ্রামের অধিকাংশ নিরীহ মানুষ। মামলা হতে বাদ পড়ে, মাছুম, রবি ও মন্টুসহ তাদের দোষররা ও পরিচালনাকারীরা। এলাকাবাসী আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। এ সুযোগে মাছুম বাহিনী দক্ষিন বুরুজ বাগান গ্রামকে মাদকের ডিপোতে পরিনত করেছে।

এ ব্যাপারে শার্শা থানা ইনচার্জ মামুন খানের কাছে আমাদের প্রতিনিধি জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি তদন্তাধিন রয়েছে, প্রকৃত অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা হবে।

শার্শা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নারায়ন চন্দ্র পাল বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে জনসচেতনতার দরকার। শুধু প্রশাসন দিয়ে মাদক ব্যবসা বন্ধ করা সম্ভব নয়। মাদক সমাজের বড় সমস্যা। আমরা মাদকের বিস্তার রোধে কঠোর ব্যবস্থা হাতে নিয়েছি। মাদকের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার জন্য সমাজের সকল শ্রেণী ও পেশার মানুষের প্রতি আমার আহবান।

শার্শা সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কবির উদ্দিন আহমেদ তোতা বলেন, নাভারনের দক্ষিন বুরুজ বাগান গ্রাম মাদকের আকড়া নামে বহুল প্রচলিত। শার্শার এ গ্রামে যেভাবে উখ্যান ঘটেছে, সেভাবে পতনের চেষ্টা করা হয়নি। তবে প্রশাসনের সদিচ্ছা থাকলে এটা বন্ধ করা অসম্ভব বলে কিছু নেই। এখানে মাদকের শীর্ষ পর্যায়ের পাঁচ সম্রাটের বসবাস। যাদের নেটওয়ার্ক সারা দেশ জুড়ে। এখানকার মাদক ব্যবসায়ীদের নামে ডজন ডজন মামলা থাকলেও তারা রয়ে যাচ্ছে ধরাছোয়ার বাইরে। গত ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তাদের খোলামেলা মাদক আড়তের রমরমা বাণিজ্য চললেও বাধা দেওয়ার যেন কেউ নেই। থানা পুলিশ, গোয়েন্দা বিভাগ, স্থানীয় নেতা থেকে শুরু করে মাদক নিয়ন্ত্রণ বিভাগের বিভিন্ন স্তরের নিরবতার ফলে বহাল থাকছে তাদের আস্তানা। সেখানে একাধারে খুচরা ও পাইকারিভাবে হরদম মাদক কেনাবেচা চলে। ইয়াবা, ফেন্সিডিল, গাঁজা, হেরোইন কী নেই সেখানে? আছে বাংলা মদেরও ছড়াছড়ি। প্রতিদিন নাভারন রেললাইন ঘেঁষা বস্তির আস্তানা ও দক্ষিন বুরুজ বাগান গ্রামের ডাক্তার মহল্লায় থেকে কমবেশি ১০ লক্ষাধিক টাকার মাদক কেনাবেচা চলে।

শার্শা উপজেলা চেয়ারম্যান সিরাজুল হক মঞ্জু বলেন, মাদক ব্যবসায়ীরা সমাজের শত্রু, এদের শনাক্ত করে সামাজিকভাবে বয়কট করা উচিত। দক্ষিন বুরুজ বাগানসহ সারা শার্শায় মাদক বিরোধী অভিযান অব্যাহত থাকলেও এলাকাবাসীর সহযোগীতা না পাওয়ায় নিয়ন্ত্রনে আনা সম্ভব হয়ে উঠছে না। পুলিশ প্রশাসনসহ সকল আইন প্রয়োগকারী সংস্থা মাদকের বিরুদ্ধে কাজ করলেও এলাকাবাসির অসহযোগীতার ফলে এর ব্যবহার দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।