গ্রামাঞ্চলে ও শহরের একটি সচরাচর দৃশ্য যে ব্যাগের ভারে হয়তো ঝুঁকে হাঁটছে শিশুটি। অথবা দেখা যায়, সন্তানের ভারী ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে চলেছেন তাদের মা-বাবা কিংবা অভিভাবক। পথ চলতে চলে দেখা যায়, স্কুলগামী বা স্কুলফেরত ছোট ছোট শিশুর ঘাড়ে ঝুলছে বড় ব্যাগ। বইয়ের সমাহার।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, খেলাচ্ছলেই শিখবে শিশুরা। আনন্দ-খুশির মধ্য দিয়ে মনের অজান্তেই শিখবে। পড়াশোনায় আনন্দ থাকবে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি তা বলে না। স্কুল বা কোচিং যাওয়া-আসায় বইয়ের পাহাড় আর পড়াশোনার চাপ।

অনেক ক্ষেত্রে আমরা উল্টাপথে যেতে পছন্দ করি। শিক্ষাক্ষেত্রেও তা–ই। প্রাইমারিতে বইয়ের চাপ বেশি, মাধ্যমিকে তুলনামূলক কম। কলেজে অনেক কম। বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচার শিট নিয়ে গেলেই হয়। অর্থাৎ ক্রমান্বয়ে বইয়ের বোঝা কমছে। কিন্তু উল্টোটাই হওয়ার কথাই ছিল।
শিশুরা আগামীদিনের ভবিষ্যৎ। কিন্তু আমাদের দেশের শিশুরা কি আগামীর ভবিষ্যৎ হিসেবে বেড়ে উঠছে? শিশুদের বিদ্যার্জনের পথে রয়েছে নানা প্রতিবন্ধকতা। এর মধ্যে ভারী স্কুলব্যাগ অন্যতম। সময় পরিক্রমায় এটি এখন বোঝাস্বরূপ। ২০১৬ সালে উচ্চ আদালত শিক্ষার্থীদের ব্যাগের ওজন কতটুকু হবে, এ নিয়ে নির্দেশনার পরও এই অবস্থার উন্নতি হয়নি। বইয়ের বোঝা শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের অন্তরায়। বিস্তারিত জানাচ্ছেন আবু বকর মোঃ রাজিব।

শৈশব ভাবতেই আমাদের চোখের সামনে ফুটে ওঠে প্রাণচঞ্চল আর উচ্ছল এক সময়, যা এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, যখন একজন বাবার সন্তানের কনিষ্ঠ আঙুলটি ধরে তার সন্তান প্রতি বিকেলে হাঁটতে বের হতো। বাবা সন্তানের খেলা দেখতে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতেন। এক সময় হয়তো এই কথাগুলো রূপকথার গল্পের মতোই শোনাবে, কারণ এখন বেশিরভাগ শিশু-শিক্ষার্থীরই শৈশবের বিকেলটা কাটে কোচিং করে, নতুবা বাসায় বসে বই পড়ে।

গাজীপুরের একটি কিন্ডারগার্টেনের কেজি থ্রিতে পড়ে নিশান। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড নির্ধারিত ৬টি পাঠ্যপুস্তক তার। এর বাইরে বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থার আরও ১০টি বই তার অতিরিক্ত পাঠ্য তালিকাভুক্ত। অর্থাৎ নিশানের মোট পাঠ্য বইয়ের সংখ্যা ১৬টি। প্রাক-প্রাথমিক থেকে শুরু করে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বোর্ড বইয়ের বাইরে অতিরিক্ত অনেক বই পড়তে দেওয়া হয় শিশুদের। সেসব বইয়ের সংখ্যা বোর্ড নির্ধারিত বইয়ের চেয়েও বেশি। কষ্ট করে ব্যাগ বহন করে নিয়ে যাচ্ছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অথবা মা-বাবা সন্তানের পেটমোটা ভারী ব্যাগ নিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন- এমন দৃশ্য প্রায়ই আমাদের চোখে পড়ে। নতুন বই হাতে পেয়ে আনন্দিত যে শিক্ষার্থী, কিছুদিন পরই তার মাঝে সেই আনন্দ আর থাকে না। বরং বইয়ের চাপে দিশেহারা হয়ে ওঠে তারা। বোর্ডের বইয়ের পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি স্কুলগুলোতে সহায়ক বইয়ের বাড়তি চাপেও রয়েছে কোমলমতি শিশু-শিক্ষার্থীরা। বিশেষ করে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বোর্ডের তিনটি ছাড়াও আরও পাঁচ থেকে সাতটি বই প্রায় সব এমপিওভুক্ত ও কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয়গুলোতে দেওয়া হচ্ছে। অন্যান্য শ্রেণিতে দুই থেকে পাঁচটি পর্যন্ত সহায়ক বই দেওয়া হচ্ছে। সহায়ক বইয়ের কারণে একদিকে শিশুদের বইয়ের বোঝা বাড়ছে, অন্যদিকে সরকার বিনামূল্যে বোর্ডের বই দিলেও সহায়ক বইয়ের জন্য এক-দুই হাজার টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে স্বল্প আয়ের অভিভাবকদের। সহায়ক বই কিনতে এই অভিভাবকদের হিমশিম অবস্থা।

তবে ওইসব স্কুল কর্তৃপক্ষের দাবি, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে থাকতে ও শিশু বয়স থেকেই সব বিষয়ে ধারণা দিতে সহায়ক বই দেওয়া হচ্ছে।

বিভিন্ন স্কুলে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে বোর্ডের বাংলা, ইংরেজি, অঙ্ক এই তিনটি বিষয়ের সঙ্গে সহায়ক হিসেবে ধর্ম, পরিবেশ-পরিচিতি, বিজ্ঞান, ওয়ার্ড বুক, চিত্রাঙ্কন, বাংলা ও ইংরেজি হাতের লেখা শেখার, সাধারণ জ্ঞান, নামতা-গুণ-ভাগ-জ্যামিতি আছে এমন একটি গণিত বই, ব্যাকরণ, গ্রামার, গল্প ও কবিতা এবং কম্পিউটার শিক্ষা সংক্রান্ত বই দেওয়া হয়ে থাকে। স্কুলভেদে এসব বইয়ের সংখ্যা ও বিষয় কম-বেশি হয়ে থাকে। তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি, অঙ্ক, বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়, বিজ্ঞান ও ধর্ম এই ছয়টি বোর্ডের বইয়ের সঙ্গে সহায়ক হিসেবে দেওয়া হয় মূলত ব্যাকরণ, গ্রামার, কম্পিউটার, চিত্রাঙ্কন, দ্রুত পঠন ধরনের দুই থেকে ছয়টি বই। অবশ্য ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণিতে এসব বইয়ের সংখ্যা কমে যায়।

প্রকাশনা সংস্থাগুলো নিজেদের মতো এসব বই তৈরি করে ও ছাপিয়ে বিভিন্ন স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে সরবরাহ করে থাকে। বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি ও শিক্ষকরা মিলে বেশ কয়েকটি প্রকাশনীর কাছ থেকে পাওয়া বইগুলো থেকে বাছাই করে বিভিন্ন শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য কয়েকটি করে নির্ধারণ করে। যদিও অভিযোগ রয়েছে, প্রকাশনী সংস্থাগুলো থেকে মোটা অঙ্কের টাকা কমিশনের বিনিময়ে কিছু স্কুল কর্তৃপক্ষ মানের প্রতি লক্ষ্য না রেখে এসব বই নির্ধারণ করে।

সরকার নির্ধারিত বইয়ের বাইরে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাড়তি বিষয় পাঠ্য করতে চাইলে তার জন্য শিক্ষা-সংশ্নিষ্ট অধিদপ্তরের অনুমতি নেওয়ার কথা বলা আছে। এমনকি বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষা আইনের চূড়ান্ত খসড়াতেও প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত প্রতিটি শ্রেণির শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যবই জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) থেকে প্রণয়ন করার কথা বলা আছে। অন্যদিকে গত ডিসেম্বরে প্রাথমিক স্কুলের শিশুদের শরীরের ওজনের ১০ শতাংশের বেশি ভারী স্কুলব্যাগ বহন নিষেধ করে সুনির্দিষ্ট একটি আইন প্রণয়নের নির্দেশ দিয়েছেন উচ্চ আদালত।
ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোতে সরকারের বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাড়াও এমন সহায়ক বই চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বই ছাড়াও বাড়ির কাজ ও স্কুলের কাজের আলাদা খাতাও নিতে হয়। স্কুল থেকেই সরাসরি কোচিংয়ে যায় অনেক শিশু। ব্যাগে তুলে নিতে হয় সেসব বইও। বই, খাতা, কলম, ডায়েরি, পেনসিল বক্স, জ্যামিতি বক্সে ব্যাগ ভারী হয়ে যায়। এ ছাড়া টিফিন বক্স ও পানির বোতল তো আছেই।
যশোর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সিনিয়র মেডিকেল অফিসার ডা. মনির হাসান বলেন, ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের শারীরিক বৃদ্ধির সময়। এ সময়টাতে শিশুদের হাড় ও মাংসপেশি অপরিণত ও নরম থাকে। ভারী স্কুলব্যাগ নিয়ে বাচ্চাদের সিঁড়ি বেয়েও উঠতে হয়। এতে ঘাড় সামনে বা পেছনের দিকে কুঁজো হয়ে যায়। তিনি বলেন, ভারী স্কুলব্যাগ বইতে শিশুদের ঘাড়, পিঠ ও মাথাব্যথা হতে পারে। এ ছাড়া শ্বাসকষ্ট ও মেরুদান্ড বাঁকাও হয়ে যেতে পারে। এমনকি শিশুর স্বাভাবিক শারীরিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সৈয়দ রাশিদুল হাসান বলেন, লেখাপড়া কোনো ব্যবসা নয়। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে জ্ঞানের ভিত্তিটাকে সুগঠিত করা। কিন্তু কিন্ডারগার্টেনগুলোতে এর উল্টো হচ্ছে। অনেকের মধ্যে ভুল ধারণা আছে, বই থেকেই শিশুরা সবকিছু শিখবে। তাই যত বেশি বই দেওয়া যায় তত ভালো। তিনি বলেন, শিশুরা মূলত পরিবার, সমাজ ও পরিবেশ থেকেই বেশি শিখে। তিনি বলেন, উন্নত দেশগুলোয় শিশুদের ‘খেলতে খেলতে শেখা’ এ তত্ত্বে পড়ানো হয়। কিন্তু এদেশে বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিশুদের চিত্তবিনোদনের সুযোগ নেই। খেলার মাঠও নেই।

স্কুলপড়ুয়া শিশু-শিক্ষার্থী মিজান বলে, ব্যাগ বহন করতে করতে পিঠে অনেক ব্যথা করে। রাতে ঘুমাতে অনেক কষ্ট হয়।’ আরেক শিক্ষার্থী আশরাফুল হক বলে, ‘বই বা খাতা না নিয়ে এলে শিক্ষকরা বকাবকি করেন।’

তারপরও দিনে দিনে শিক্ষার্থীদের ওপর বইয়ের চাপ বাড়ছেই। ঠিকঠাক সবকিছু বুঝে ওঠার আগেই শিশুদের হাতে তুলে দেওয়া হয় বাড়তি বই। পুঁথিগত বিদ্যার ওপরই বেশি জোর দেওয়া হয়। তাই বয়সের তুলনায় বেশি বই ছাত্রছাত্রীদের শুধু বহন করতেই হয় না, মুখস্থও করতে হয়। এভাবে বেশি চাপে শিশুরা পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারে। নষ্ট হতে পারে সৃষ্টিশীল মেধা।

অভিভাবক মো. সাইদুল ইসলাম বলেন, বাসায় সারাদিন চার দেয়ালে বন্দি থাকে শিশুরা। স্কুলেও একই অবস্থা। আরেক অভিভাবক মোঃ হাসান জানান, স্কুল থেকে বাচ্চাদের যে পড়া দেওয়া হয়, তা তৈরি করতে দিন ও রাতের অধিকাংশ সময় ব্যয় হয়। মাত্রাতিরিক্ত চাপের কারণে শিক্ষার্থীরা স্কুলে যেতে চায় না। তিনি বলেন, তাই আগামী বছর আমি আমার বাচ্চাকে অন্য স্কুলে দেওয়ার চিন্তা করছি। অভিভাবক শান্তা ইসলাম বলেন, শিশুরা পরীক্ষার্থী না শিক্ষার্থী- তা-ই বুঝি না। ক্লাস টেস্ট, সাপ্তাহিক, মাসিক পরীক্ষা একটার ফল পেতে না পেতেই আরেকটি পরীক্ষার ফি দিতে হচ্ছে।

শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত যেন না হয়, সেজন্য সরকারকে এ বিষয়ে আইন প্রণয়নের নির্দেশনা দেন হাইকোর্ট। নির্দেশনা দেন রায়ের কপি পাওয়ার ছয় মাসের মধ্যেই এটি কার্যকর করতে, যা ছিল হাইকোর্টের একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, সেই রায় আজ অবধি বাস্তবায়ন হয়নি।

২০১৬ সালের এক রায়ে হাইকোর্ট শিশু-শিক্ষার্থীদের ব্যাগের ওজন কী পরিমাণ হবে সে বিষয়ে সরকারকে আইন প্রণয়নের নির্দেশ দিয়েছিলেন। একই সঙ্গে হাইকোর্ট শিশুর শরীরের ওজনের ১০ শতাংশের বেশি ওজনের ব্যাগ বহনের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেন।

প্রসঙ্গক্রমে বলতে হচ্ছে- আজ যারা দেশের কর্ণধার কিংবা উচ্চপর্যায়ে আসীন, তাদের অধিকাংশই সনাতনী শিক্ষা ব্যবস্থায় পড়ে এসেছেন। আকাশচুম্বী সফলতাও অর্জন করেছেন তারা। তাদের কিন্তু কিন্ডারগার্টেনে পড়তে হয়নি। পড়তে হয়নি ইংলিশ মিডিয়ামেও। অথচ তারা কম মেধাবী, তা বলা যাবে না। তাই অতিরিক্ত বইয়ের বোঝা শিশুদের শুধু শারীরিক ক্ষতির কারণই নয়, একই সঙ্গে মানসিক বিকাশেরও অন্তরায়।
শিক্ষাবিদ ও চিকিৎসকেরা শিশুদের ওপর থেকে বইয়ের বোঝা কমানোর তাগিদ দিয়ে বলেছেন। যেকোনো উপায়ে বইয়ের সংখ্যা কমানো জরুরি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুমোদনহীন বই চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে নিতে হবে কঠোর পদক্ষেপ। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে আরও সক্রিয় হতে হবে।