জেলার খবর, সিলেট, সিলেট বিভাগ | তারিখঃ মে ২১, ২০২২ | নিউজ টি পড়া হয়েছেঃ 2451 বার
স্টাফ রিপোর্টার, সিলেট অফিস ॥ বন্যাকবলিত এলাকায় দুর্ভোগ বাড়ছে। শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ খাবার পানির সঙ্কট চলছে। বন্যার ৮দিন পেরিয়ে গেলেও সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির কোন উন্নতি হয়নি। নগরীর বিভিন্ন এলাকা ও সদর উপজেলার কিছু এলাকা থেকে শুক্রবার পানি কিছুটা কমলেও রাস্তাঘাট বাসা বাড়ি এখনও পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। থেমে থেমে বৃষ্টি ও উজানের ঢল অব্যাহত রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় পরিস্থিতি কোথাও অপরিবর্তিত কোথাও অবনতি হয়েছে। টানা ৮ দিন ধরে সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সিলেট নগরসহ জেলার ১৩টি উপজেলায় প্লাবিত হওয়া গ্রামাঞ্চল পানিতে থৈ থৈ করছে। এতে হাজার হাজার মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন, অন্যদিকে ঘরের মজুত খাবারও শেষ হয়ে গেছে। বন্যাদুর্গত মানুষ পর্যাপ্ত ত্রাণ পাচ্ছেন না বলেও অনেকে অভিযোগ করেছেন। এতে দুর্গত এলাকাগুলোতে নানামুখী বিপর্যয়ের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। বানভাসিরা বলছেন, অনেক ঘরবাড়িতে এখনও বুক ও গলা সমান পানি। অনেকে নিজের বাড়িঘর ছেড়ে নিরাপদে আশ্রয় নিয়েছেন। কেউ কেউ ঘরের ভেতরে মাচা বানিয়ে থাকছেন।
সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, জৈন্তাপুর, জকিগঞ্জ উপজেলাসহ প্রত্যন্ত এলাকায় ইঞ্জিন নৌকার শব্দ শুনলেই তারা ত্রাণের আশায় ছুটে আসছেন। বন্যাকবলিত এলাকার মানুষ পানিবাহিত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। সাপ, পোকামাকড় ও জোঁকের উপদ্রব বেড়েছে। শৌচাগার ডুবে যাওয়ায়ও চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। উপজেলা সদরের সঙ্গে অধিকাংশ এলাকার মানুষের সড়কপথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে মানুষ নৌকা ও কলাগাছ দিয়ে তৈরি ভেলা ব্যবহার করছে।
সিলেট নগরের বন্যাক্রান্তরাও খাবার ও বিশুদ্ধ পানি সঙ্কটে পড়েছেন বলে অনেকে অভিযোগ করেছেন। নগরের আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়া অনেকে বলছেন, তারা প্রয়োজনীয় খাবার সহায়তা পাচ্ছেন না। খাবার সঙ্কটে তাদের অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। প্রয়োজনের তুলনায় ত্রাণ বরাদ্দ একেবারেই কম। একইসঙ্গে বিশুদ্ধ পানিও পাচ্ছেন না তারা। বৃষ্টির পানি জমিয়ে খাবার চাহিদা মেটাচ্ছেন। সিলেট আবহাওয়া অধিদফতরের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ চৌধুরী জানান, আগামী রবিবার পর্যন্ত সিলেটে ভারি বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস আছে। রবিবার দিবাগত রাত থেকে বৃষ্টিপাত কমে পরের দিন সোম ও মঙ্গলবার আকাশ পরিষ্কার হবে। এরপর ফের বৃষ্টিপাত হতে পারে।
সিলেট মহানগরের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের জরুরী সভায় বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে সিসিকের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমানকে প্রধান করে একটি কন্ট্রোল রুম খোলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। নগরীর নদী তীরবর্তী বিভিন্ন ওয়ার্ডের আশ্রয়কেন্দ্র ও বাসা-বাড়িতে থাকা পানি বন্দী মানুষের তালিকা দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রণয়ন ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, আশ্রয় কেন্দ্রসমূহে বন্যার্তদের জন্য খাবার ব্যবস্থা করা, শিশু খাদ্য সরবরাহ ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সিসিকের ৩টি মেডিক্যাল টিম গঠন করা হয়। এ ছাড়া প্লাবিত এলাকার মানুষের বিশুদ্ধ খাবার পানি সঙ্কট নিরসনে ১ লাখ পিস পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
ইতোমধ্যে আশ্রয় কেন্দ্র ও পানি বন্দী মানুষের খাবার পানির সঙ্কট নিরসনে সিসিকের পানির গাড়ি পাঠানো হয়েছে। পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত এই সেবা অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এদিকে সিসিকের মেডিক্যাল টিমগুলো বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান নেয়া মানুষের স্বাস্থ্য সেবা প্রদান করবে। বৃহস্পতিবার রাত থেকেই বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে শুকনো খাবারের পাশাপাশি বন্যার্তদের দেয়া হচ্ছে রান্না করা খাবার (খিচুড়ি)। পরিস্থিতি বিবেচনায় খাবার বিতরণ অব্যাহত থাকবে।
এই পরিস্থিতিতে সিলেট মহানগরের বন্যাকবলিত এলাকার মানুষের সাহায্যে সিসিক সর্বাত্মক চেষ্টা করবে বলে জানিয়েছেন সিসিক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। এ অবস্থায় সিলেটের দুর্গত মানুষের জন্য সরকারও বিশেষ সহযোগিতা প্রদান করবে বলে প্রত্যাশা সিসিকের।
আউশের ক্ষতি সিলেটে এবার বেশ কিছু এলাকায় ঢলের পানিতে বোরো ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বোরোর পর এবার আউশেও আঘাত হানলো বন্যা। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসের হিসেবে, চলমান বন্যায় বৃহস্পতিবার পর্যন্ত আউশ ধানের বীজতলা এক হাজার ৩০১ হেক্টর, বোরো ধান এক হাজার ৭০৪ হেক্টর এবং গ্রীষ্মকালীন সবজি এক হাজার ৪ হেক্টর পানিতে তলিয়ে গেছে।
জকিগঞ্জের ডাইকে ভাঙ্গন ॥ শুক্রবারও সিলেটে বৃষ্টিপাত অব্যাহত ছিল। এরআগে বৃহস্পতিবার রাতেও ভারি বৃষ্টিপাত হয়েছে। জকিগঞ্জ উপজেলার অমলশিদ এলাকায় সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর উৎসস্থলের একটি ডাইক (নদী প্রতিরক্ষা বাঁধ) ভেঙ্গে প্রবল বেগে পানি ঢুকে জকিগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলের তীব্র স্রোতে ভারতের সীমান্তবর্তী বরাক নদের মোহনায় ডাইকটি ভেঙ্গে গেছে। এর পর মুহূর্তেই জকিগঞ্জের ফিল্লাকান্দি, অমলশিদ, বারঠাকুরী, খাসিরচক, খাইরচক, বারোঘাট্টা, সোনাসারসহ বেশ কিছু এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। একই সঙ্গে জকিগঞ্জ উপজেলা সদরের সঙ্গে অমলশিদ যাতায়াতের রাস্তাটিও পানিতে ডুবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ফলে এ রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ আছে। ডাইক ভেঙ্গে পানি ঢুকতে থাকায় আগে থেকেই প্লাবিত উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভার বিভিন্ন এলাকায় পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভারতের বরাক নদ থেকে প্রবল বেগে পানি এখন সুরমা ও কুশিয়ারা নদীতে গিয়ে ঢুকছে। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, তীব্র পাহাড়ী ঢলের ধাক্কায় ডাইকটি ক্রমশ ভেঙ্গে শুক্রবার সকাল পৌনে নয়টার দিকে ডাইকের কমপক্ষে ৬০ ফুট অংশ ভেঙ্গে গেছে।
জকিগঞ্জ উপজেলার অমশসীদ এলাকার বাসিন্দা মাওলানা মখলেছুর রহমান পেশায় শিক্ষক। তিনি বলেন, ‘শুনেছি ত্রাণ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। আমরা পাইনি এবং দেখিনি। আমাদের এলাকার অনেকেই খুবই খারাপ অবস্থায় আছেন। খেয়ে না খেয়ে বেঁচে আছেন।’
মালেখা বিবি নামে ৫০ বয়সী এক নারী বলেন, ‘আমাদের কেউ সাহায্য করেনি। আমরা খুব কষ্টে আছি।’
কানাইঘাটে ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজ স্থগিত ॥ বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদের কার্যক্রম শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ২০ মে একযোগে এই কার্যক্রম শুরু হলেও সিলেটের কানাইঘাট উপজেলায় শুরু করা যাচ্ছে না বন্যার কারণে। তাই আপাতত ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজ এখানে স্থগিত থাকবে বলে জানিয়েছে ইসি। ইসির নির্বাচন সহায়তা শাখার সহকারী সচিব মোঃ মোশাররফ হোসেন স্বাক্ষরিত এক আদেশে বলা হয়েছে- ভোটার তালিকা হালনাগাদ কর্মসূচী-২০২২ এর প্রথম ধাপে তফসিল ঘোষিত সিলেট জেলার কানাইঘাট উপজেলায় ২০ মে থেকে তথ্য সংগ্রহ কার্যক্রম আকস্মিক বন্যাজনিত কারণে স্থগিত রাখা হলো। সেই সঙ্গে তথ্য সংগ্রহের কার্যক্রম পরবর্তী দুই সপ্তাহ পর থেকে যথারীতি শুরু করা হবে বলে জানানো হয়। এই কার্যক্রম চলবে আপাতত ২০ নবেম্বর পর্যন্ত। অন্যদিকে উপজেলার দীঘিরপাড় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল ১৫ জুন। পরবর্তী নির্দেশনা না দেয়া এ নির্বাচন বন্ধ থাকবে বলে জানিয়েছে ইসি।
প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন শেষে বন্যাদুর্গতদের সঙ্গে কথা বলে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেন।
সুনামগঞ্জের হাওড়ে বন্যার অবনতি ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা সুনামগঞ্জ থেকে জানান, সুনামগঞ্জ জেলার বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকলেও হাওড়াঞ্চলে আরও অবনতি হয়েছে বন্য্রা। গত ২৪ ঘণ্টায় সুনামগঞ্জে ৫৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে এবং সুরমা নদীর পানি ষোলঘর পয়েন্টে ১৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। বন্যায় পানিবন্দী মানুষ মানবেতর জীবন কাটাছে। দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের সঙ্কট। বাড়ি-ঘর, রাস্তাঘাটে পানি ওঠায় অন্যত্র উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন বন্যার্ত অনেক পরিবার। কেউ কেউ উপায় না পেয়ে বাধ্য হয়ে ঘরের ওপর মাচা তৈরি করে বা খাটের ওপর অনিশ্চিত সময় পার করছেন। জেলার ৬ উপজেলার লক্ষাধিক মানুষ এখন বন্যা কবলিত। এসব এলাকায় ঢলের পানিতে ভেঙ্গে গেছে কাঁচা ও আধাপাকা সড়ক।
সুরমা নদী তীরবর্তী সদর, বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর, দোয়ারাবাজার, ছাতক, ধর্মপাশা উপজেলার নিম্নাঞ্চলের অনেক সেতুর সংযোগ অংশ ভেঙ্গে যাওয়ার ওসব এলাকা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে।
জেলার ছাতক-সুনামগঞ্জ-সিলেট, তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর-সুনামগঞ্জ এবং সুনামগঞ্জ-হালুয়াঘাট-মঙ্গলকাটা সড়কে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের গোবিন্দগঞ্জ এলাকায় পানি ওঠায় যান চলাচলে ভোগান্তির সৃষ্টি হয়েছে জেলা সদরসহ সিলেট-ঢাকাগামী যাত্রীদের।
এদিকে ভারি বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় এবং ভারতের চেরাপুঞ্জি ও মেঘালয়ে বৃষ্টিপাত থাকার ফলে পাহাড়ি ঢলে জেলার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। এখনও কয়েক উপজেলার লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এতে বিভিন্ন পানি বাহিত রোগের প্রকোপ দেখা দেয়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। এই জেলার পাঁচ শতাধিক মৎস্য খামার ভেসে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন অন্তত কয়েক হাজার খামারি। এদিকে জেলার ২৫৬ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পানি প্রবেশ করার ফলে সাময়িক বন্ধ রাখা হয়েছে এবং ২৮ টিতে আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে।
সুনামগঞ্জ কৃষি বিভাগের উপ-পরিচালক বিমল চন্দ্র সোম জানিয়েছেন- গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিপাত থাকায় সুনামগঞ্জ সদর, বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর, ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলায় ৭৭৭ হেক্টর বোরো ধান, ৭৫ হেক্টর বাদাম, আউশ বীজতলা ৭৪ হেক্টর, সবজি ৬০ হেক্টর, আউশ ধান ২০ হেক্টর পানিতে তলিয়ে যায়। এতে ক্ষতির পরিমান ৮০ লাখ টাকা হবে।
এদিকে সুনামগঞ্জ জেলা মৎস্য অফিসার সুনীল মন্ডল জানিয়েছেন, টানা কয়েকদিনের বৃষ্টিপাতের ফলে জেলার সদর, ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলায় প্রায় সাড়ে ৪ শ’ পুকুর ডুবে ৩৫ টন মাছ ও ৩০ লাখ পোনা বানের পানিতে ভেসে যায়, যার ক্ষতির পরিমাণ প্রায় আড়াই কোটি টাকা হবে।