নজরুল মিয়া মাগুরা থেকে : জিনিসপত্রের উর্দ্ধগতির কারণে মনে হয় বাজারে আগুন লেগেছে। তাই ‘এখন খাতি হয় হিসাব কইরে’ জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেকে পণ্য কেনার পরিমাণ কমিয়ে দেন। আগে যেখানে এক কেজি কিনত, এখন সেখানে আধা কেজি কিনছে।
আলীম মোল্যা (৩৮) পাঁচজনের পরিবার। দুই ছেলে ও এক মেয়েসহ স্বামী–স্ত্রী থাকেন মাগুরা শহরতলির পারনান্দুয়ালী গ্রামে। এই পরিবারে মাসে চাল লাগে ৬০ কেজি। ডাল ৫ কেজি, আটা ১০ কেজি, পেঁয়াজ ৫ কেজি, রসুন ২ কেজি, মরিচ ৩ কেজি, চিনি লাগে ২ কেজি। সয়াবিন তেল লাগে মাসে ৬ লিটার। এর পাশাপাশি মাসে ১ হাজার ৫০০ টাকার সবজি এবং ৩ হাজার টাকার মাছ কিনতে হয়। এর বাইরে সন্তানদের লেখাপড়াসহ এই পরিবারের মাসিক খরচ ১৫ হাজার টাকার মতো। মাসিক এই খরচ মেটাতে চায়ের দোকানদার আমীন মোল্লাকে স্কুলপড়ুয়া দুই ছেলেকেও কাজে লাগাতে হয়। তাতেও চলে না।
মাগুরা শহরের ইসলামপুরপাড়া নবগঙ্গা নদীর তীরে আলীমের ছোট চায়ের দোকান। সেখানেই তাঁর সঙ্গে কথা হয় গ্রামের সংবাদ পত্রিকার এই প্রতিবেদকের। তিনি জানান, আগে চটের ব্যাগের ব্যবসা করতেন। প্রায় দুই দশকের ওই ব্যবসা ছাড়তে হয়েছে করোনার প্রভাবে। অতিমারি শুরুর আগে তাঁর এই ব্যবসা থেকে মাসে আয় হতো ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। সেখানে করোনার ধাক্কায় পুঁজি হারিয়ে বদলাতে হয়েছে ব্যবসার ধরন। টিকে থাকার জন্য চায়ের অস্থায়ী দোকান নিয়ে বসেছেন। সেখান থেকে মাসে আয় হয় সর্বোচ্চ ৯ হাজার টাকা।
পাঁচজনের সংসারে খরচ যেখানে ১৫ হাজার টাকা, সেখানে এই ঘাটতি তাহলে পূরণ হয় কী করে—এমন প্রশ্নের জবাবে আলীম মোল্লা বলেন, ‘গত বছর বাধ্য হয়ে স্কুলপড়ুয়া দুই ছেলেকে কাজে দিয়েছি। দুজন মিলে পায় ৫ হাজার টাকা আয় করে। এই কাজ করতে গিয়ে এক ছেলের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে। অন্যজন কাজের পাশে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এভাবেই কোনোরকমে টিকে আছি।’
গত বছর বাধ্য হয়ে স্কুলপড়ুয়া দুই ছেলেকে কাজে দিয়েছি। এক ছেলের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে। অন্যজন কাজের পাশে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। কোনোরকমে টিকে আছি।
আলীম মোল্লা, পারনান্দুয়ালী গ্রামের বাসিন্দা, মাগুরা শহরতলি
মাগুরা শহরের নতুন বাজারে খাসজমিতে ঘর তৈরি করে পরিবারসহ থাকেন তহমিনা বেগম (৪০)। ছয়জনের পরিবারে মাসে খরচ হয় ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা। স্বামী ও এক ছেলে কাজ করার পরও পরিবারের এই খরচ মেটাতে হিমশিম খেতে হয় এই গৃহিণীর। তহমিনার স্বামী বাঁশের তৈরি পণ্য বিক্রি করে সংসারে দেন ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা। আর ছেলে মোটরসাইকেলের ওয়ার্কশপে কাজ করে মাসে আয় করে ৮ হাজার টাকা।
হিসাব কষে দেখা যায়, প্রতি মাসেই কিছু টাকা ঘাটতি থেকে যায়। তার ওপর এখন নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। তাহলে কীভাবে চলছে সংসার, জানতে চাইলে তহমিনার জবাব, ‘করোনার কারণে আয় কমে গেছে, খচ্চা বাইর্যা গেছে। তাতে বাধ্য হয়ে চাহিদা কমাতি হয়েছে। আগে যেখানে আধা কেজি কিনতাম, এখন সেখানে এক পোয়া কিনতে হচ্ছে। সবকিছুই কিনতে হয় অল্প অল্প। এখন আর পেট ভইরে খাওয়া হয় না, খাতি হয় হিসাব কইরে।’
মাগুরা শহরের কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা যায়, গত শনিবার খুচরা বাজারে মোটা চাল প্রতি কেজি ৪২ টাকা, চিকন চাল ৬৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। চিকন মসুরের ডাল কেজি ১২০ টাকা, পেঁয়াজ ৩০ টাকা, রসুন ৪০, চিনি ৮০ টাকা, লবণ ৩৫ টাকা এবং প্রতি লিটার সয়াবিন ১৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
জানতে চাইলে ভায়না কাঁচা বাজারের ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান গ্রামের সংবাদকে বলেন, ‘বাজারে পণ্যের আমদানির ওপর দাম ওঠানামা করে। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেলে মানুষ ওই নির্দিষ্ট পণ্য কেনার পরিমাণ কমিয়ে দেয়।’
মাগুরা কৃষি বিপণন কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, গত বছরের মার্চের তুলনায় চলতি বছরের মার্চে খুচরা বাজারে সরু চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ৫ টাকা। এক বছর আগে ওই চাল যেখানে বিক্রি হয়েছে ৫৮ থেকে ৬০ টাকা। সেখানে এখন প্রতি কেজি ৬৩ থেকে ৬৫ টাকা। এই কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, খুচরা বাজারে মোটা চালের দাম প্রতি কেজি ৪২ থেকে ৪৩ টাকায় স্থিতিশীল। গত বছরের তুলনায় খোলা আটার দাম কেজিতে ৭ টাকা এবং প্যাকেট আটার দাম বেড়েছে ৬ টাকা। চিনির দাম বেড়েছে কেজিতে অন্তত ১৪ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে খোলা ও বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে ৪২ থেকে ৪৩ টাকা। খোলা সয়াবিন ১১০ টাকার জায়গায় এখন ১৫২ টাকা প্রতি লিটার। সেখানে বোতলজাত সয়াবিন ১২৩ টাকা থেকে বেড়ে ১৬৮ টাকায় দাঁড়িয়েছে।
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ আব্দুল মুননাফ, মোবাইল : ০১৭১১ ৩৫৯৬৩১, ইমেইল: gsongbad440@gmail.com, IT Support: Trust Soft BD
Copyright © 2024 gramer songbad. All rights reserved.