আসাদুজ্জামান আসাদ।৷ যশোরের শার্শা উপজেলার বিস্তৃত এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে বিষাক্ত আগাছা পার্থেনিয়াম। এতে মানুষ ও গবাদিপশুর স্বাস্থ্যঝুঁকি যেমন বেড়েছে, তেমনি ফসল উৎপাদনও কমে আসছে। মারাত্মক হুমকির মুখে রয়েছে জীব ও উদ্ভিদ বৈচিত্র্য।
কৃষি বিভাগ বলছে,পার্থেনিয়াম হলুদ, আদা, কলা, দেশীয় শিম, আমের বাগান ও মটর ক্ষেতকে আক্রান্ত করছে। এই পরগাছাটি অ্যালিলোপ্যাথিক যৌগগুলোর মাধ্যমে বেগুন, টমেটো, মরিচ ইত্যাদির পরাগায়ন কমিয়ে ফেলে। গম, ভুট্টা, মরিচ, শিম, টমেটো ও বেগুনের ফল ও দানার গঠন এ আগাছার আক্রমণে ব্যহত হয়।আমের উৎপাদন কমিয়ে দেয়।
রাস্তার দু’পাশে সবুজ ঝোপ। আপাত ভাবে নয়নাভিরাম দৃশ্য। কিন্তু এই শোভা বাড়িয়েছে পার্থেনিয়াম। বিষাক্ত এই আগাছ থেকে নানা রোগ হতে পারে। অথচ স্থানীয় মানুষের বিশেষ কোনও ধারণাই নেই সে সম্বন্ধে।
ধনিয়া গাছের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ এই আগাছাটি দুই দশক আগেও এই দেশে ছিল না। পাতা অনেকটা ধনিয়া কিম্বা গাজর গাছের মতো। স্থানীয় মানুষ একে ‘গাজর গাছ’ও বলেন। গাছগুলি ৩-৪ হাত লম্বা। ছোট ছোট সাদা রঙের ফুল ধরে তাতে।
পার্থেনিয়াম গাছে সাদা সাদা ফুল হয়। দেখতেও সুন্দর। ধীরে ধীরে আগাছাগুলো বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে জমিটি ভরে যায়।বুধবার একজনকে নিয়ে নাভারন সাতক্ষীরা মহাসড়কের বেত্রাবতী ফিলিং স্টেশনের দক্ষিণ পার্শে আগাছাগুলো কেটে ফেলেন আফ্ফার আলি।এর পর তাদের শরীরে চুলকানি দেখা দেয়। আফ্ফার আলি বলেন, আমরা জানতাম না এটা ক্ষতিকর আগাছা। তাই নাকমুখ না ঢেকেই এগুলো কেটে ফেলি। পরে দেখি গা-হাত-পা চুলকাচ্ছে। এতে শরীরের বিভিন্ন স্থানে ফুলে যায়।
আফ্ফার আলির মতো অনেকেই জানেন না, ভয়ংকর এই আগাছার নাম পার্থেনিয়াম।এটি পরিবেশ,ফসল, মানবদেহ ও গবাদি পশুর জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। পার্থেনিয়ামের ইংরেজি নাম perthenium এবং বৈজ্ঞানিক নাম parthenium hysterophorus. এর জন্ম উত্তর আমেরিকায়। তবে বিভিন্ন আমদানি খাদ্যপণ্যের সঙ্গে এটি বাংলাদেশে বিস্তার লাভ করেছে।
গত কয়েক বছর ধরে সীমান্তবর্তী জেলা যশোরের বিভিন্ন সড়ক ও অনাবাদি জমি ভয়ংকর এই আগাছায় ভরে গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবেশ ও কৃষির নীরব ঘাতক পার্থেনিয়াম। এটি দ্রুত বংশ বিস্তার করে। প্রতিটি আগাছা থেকে বীজ জন্মে ১৫ থেকে ২০ হাজার। ফলে দ্রুতই কৃষিজমিতে এই আগাছা ছড়িয়ে পড়ছে। গবাদি পশু চরানোর সময় এটি গায়ে লাগলে পশুর শরীর ফুলে যায়। এ ছাড়া তীব্র জ্বর, বদহজমসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়। গাভী পার্থেনিয়াম খেলে দুধ তিতা হয়। ওই দুধ অনবরত কেউ খেলে সেই মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। পার্থেনিয়াম আরও ছড়িয়ে পড়লে জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে পড়বে। ফসল উৎপাদন বাধাগ্রস্তসহ মানুষ ও গবাদি পশুর স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়বে।
কৃষি বিভাগ বলছে, বাংলাদেশে ২০০৮ সালে যশোরে পার্থেনিয়ামের উপস্থিতি প্রথম শনাক্ত করা হয়। তখন এ ব্যাপারে তথ্যানুসন্ধানে এদেশে এসেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক স্টিভ অ্যাডকিনসের নেতৃত্বে একদল কৃষিবিজ্ঞানী। এদেশে ছড়িয়ে পড়া পার্থেনিয়ামের বৈজ্ঞানিক নাম Parthenium hysterophorus। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এর ১৬টি প্রজাতির মধ্যে এটিই সবচেয়ে বিষাক্ত উদ্ভিদ। বাংলাদেশে এটি নাকফুল হিসেবে পরিচিত। পার্থেনিয়ামের তথ্যানুসন্ধানে ২০১৪-১৭ সাল পর্যন্ত দেশের ৩৫টি জেলায় জরিপ চালানো হয়। তাতে দেখা যায়, বিষাক্ত এই গাছটি ভারতের সীমান্তবর্তী বৃহত্তর যশোর, রাজশাহী ও ময়মনসিংহ অঞ্চলেই বেশি।
যশোর জেলার সড়ক মহাসড়কের প্রায় সব রাস্তার দুই ধারে এ বছর ব্যাপকহারে পার্থেনিয়াম দেখা যাচ্ছে। এর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে কৃষকদের সচেতন করতে এবং অপসারণ বিষয়ে কাউকে কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। ফলে নির্বিঘ্নে বেড়ে উঠেছে এই ক্ষতিকর আগাছা।
শার্শা উপজেলার হাড়িখালি গ্রামের কৃষক আকবর আলি বলেন, চার-পাঁচ বছর আগেও এই আগাছা আমাদের চোখে পড়েনি। এখন উপজেলার প্রতিটি সড়কের ধারসহ অনাবাদি জমি পার্থেনিয়ামে ভরে গেছে।
উপজেলার জামতলা বাজারের ব্যবসায়ী সরিফুল ইসলাম বলেন, উপজেলার প্রায় সব রাস্তায় এই আগাছা দেখা যাচ্ছে। ক্ষতিকর আগাছাটি অপসারণে কেউ কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
নাভারন ফজিলাতুননেছা সরকারি মহিলা কলেজের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের প্রধান মুস্তাক আহম্মেদ বলেন, পার্থেনিয়াম গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ। এই আগাছার মধ্যে এক ধরনের কেমিক্যাল আছে, যা শুধু ফসলেরই নয়, মানবদেহ ও গবাদি পশুর ক্ষতি করতে পারে। মানুষ এর সংস্পর্শে এলে অ্যালার্জি, অ্যাজমা, চর্মরোগ, ব্রঙ্কিওলাইটিসসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হতে পারে। তাই এটা দ্রুত নির্মূল করা প্রয়োজন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের শার্শা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা দীপক কুমার সাহা বলেন, পার্থেনিয়াম নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন সময় এর ক্ষতিকর দিকগুলো কৃষকদের মাঝে তুলে ধরা হচ্ছে। এটি নির্মূলে সরকারি কোনো বাজেট নেই। তবে কৃষকদের আমরা এর ক্ষতিকর প্রভাব এবং পরিবেশ রক্ষার্থে এটি নির্মূল করা জরুরি বলে প্রচার চালাচ্ছি। এই আগাছা পরিষ্কারের সময় হাতে গ্লাভস, চোখে চশমা থাকলে ভালো হয়। পা ভালোমতো ঢেকে রাখতে হবে।
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ আব্দুল মুননাফ, মোবাইল : ০১৭১১ ৩৫৯৬৩১, ইমেইল: gsongbad440@gmail.com, IT Support: Trust Soft BD
Copyright © 2024 gramer songbad. All rights reserved.