গ্রামের সংবাদ ডেস্ক : চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে ‘আশরাফ বাহিনীর’ সশস্ত্র সন্ত্রাসী হামলায় জেলা পরিষদের সদস্য ও নয়ালাভাঙ্গা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সালামসহ দু’জন নিহত হয়েছেন। বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে উপজেলার রাণীহাটি কলেজের সামনে এ ঘটনা ঘটে।

আবদুস সালাম উপজেলার নয়ালাভাঙ্গা ইউনিয়নের মোড়লপাড়া গ্রামের মো. এত্তাজ আলীর ছেলে। নিহত অন্যজন হলেন মতিন আলী। তিনি হরিনগর উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ও ফতেপুর গ্রামের আব্দুল মান্নানের ছেলে। স্থানীয়রা বলছেন, বিএনপি নেতা ও ইউপি সদস্য আলম আলী হত্যার বদলা নেয়ার ঘোষণা দিয়ে অতর্কিত হামলা চালিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুস সালামকে খুন করেছে আশরাফ বাহিনী। গেল বছর খুন হওয়া ইউপি সদস্য আলম বিএনপি নেতা ও সাবেক চেয়ারম্যান আশরাফের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এরআগে একই স্টাইলে খুন করা হয় আলম হত্যা মামলার আসামি দুরুলকে।

পুলিশ জানায়, রাত সাড়ে ৮টার দিকে রাণীহাটি কলেজের সামনে আশ্রয়ণ প্রকল্পের কাছে একটি চায়ের দোকানের সামনে বসে ছিলেন আব্দুস সালামসহ তার সঙ্গীরা। এ সময় হঠাৎ দুর্বৃত্তরা ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। পাশাপাশি গুলি চালালে ঘটনাস্থলেই নিহত হন সালাম। গুলিবিদ্ধ হন মতিন।

মতিনকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। হাসপাতালের জরুরি বিভাগের দায়িত্বরত চিকিৎসক মিম ইফতেখার জাহান বলেন, রাত ৯টার দিকে মতিনকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। লাশের মাথা ও পায়ে গুলির চিহ্ন রয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে দীর্ঘদিন ধরে সন্ত্রাসীরা ককটেলের ব্যবহার করে আসছেন। তবে সন্ত্রসীরা এই প্রথম হত্যাকাণ্ডে অস্ত্রের ব্যবহার করেছে।

রাণীহাটি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ‘আশরাফ বাহিনী’র লোকজন এ সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছেন বলে দাবি করছেন ওই হামলায় আহত ও প্রত্যক্ষদর্শী রহিম বাদশা। জানতে চাইলে চাঁপাইনবাবগঞ্জের পুলিশ সুপার বলেন, আশরাফের গ্রুপ সম্পর্কে জেনেছি। সব তথ্য যাচাই করা হচ্ছে। হামলাকারীদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

পুলিশ ও স্থানীয়রা বলছেন, আশরাফুল হক এক ‘ভয়ঙ্কর’ চরিত্রের নাম। গত তিন দশকে অসংখ্য হত্যার যিনি মাস্টারমাইন্ড। তার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ককটেল বাহিনী। যারা সবাই ককটেল তৈরি করতে পারেন। আশরাফুল হকের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার নয়ালাভাঙ্গা ইউনিয়নে। তিনি উপজেলা বিএনপি’র সভাপতি ও নয়ালাভাঙ্গা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। এখন আওয়ামী লীগ নেতা ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গেই তার গভীর সখ্যতা। নিজের দাপুটে প্রভাব ধরে রাখতে আওয়ামী লীগের এমপি ও প্রশাসনকে ম্যানেজ করে চলেন। তাদের সুপারিশে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বড় বড় ঠিকাদারি কাজও পান তিনি। এই আশরাফ মানুষ খুন করে চাঁপাইনবাবগঞ্জে ত্রাসের রাজস্ব কায়েম করেছে। বেশভূষা দেখে বোঝার উপায় নেই, পুলিশের খাতায় তিনি ত্রাস/সন্ত্রাস সৃষ্টিকারী, হত্যাকারী হিসেবে পরিচিত।

পিসিপিআরে আশরাফের বিরুদ্ধে ২১টি মামলার তথ্য রয়েছে। এই আশরাফ অপরাধ জগতে নাম লেখান ৯০-এর দশকের আগেই। আর পিসিপিআরে তথ্য রয়েছে ২০০৬ সাল পর্যন্ত।

স্থানীয়রা বলছেন, নয়ালাভাঙ্গা ইউনিয়নে তিন দশকের বেশি সময় ধরে রাজনৈতিক আধিপত্যের দ্বন্দ্ব চলছে। স্থানীয় বাসিন্দা, একাধিক রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের ভাষ্য, আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টাই এসব হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য কারণ। এখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতা আছে এমনটিও বলছেন কেউ কেউ। আশরাফুল হক ১৯৮৯ সাল থেকে আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় মরিয়া। তিনি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হওয়ার পর এলাকায় আধিপত্যের সংঘাত আরও বেড়ে যায়। রাজনৈতিক বিরোধের কারণে নয়ালাভাঙ্গায় রক্ত ঝরছেই। জনপ্রতিনিধি কিংবা সাধারণ মানুষ কেউ নিরাপদ নয়। যারা আশরাফের বিরোধিতা করেছেন আব্দুস সালামের মতো তাদের সবাইকে লাশ হতে হয়েছে। অধিকাংশ হত্যাকাণ্ড তিনি কারাগারে থাকা অবস্থায় ঘটিয়েছেন। মামলা থেকে বাঁচার এটি তার কৌশল।

আওয়ামী লীগ নেতা সালাম হত্যার নেপথ্যে: গেল বছর পরাজিত ইউপি সদস্য আওয়ামী লীগ নেতা আঙুর বাহিনীর হাতে খুন হন বিজয়ী ইউপি সদস্য বিএনপি নেতা আলম আলী। এই আলম সাবেক চেয়ারম্যান আশরাফের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এ ঘটনার পর থেকে প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে ওঠে আশরাফ বাহিনী। হত্যার বদলা নেয়ার ঘোষণা দিয়ে ককটেল হাতে পুরো এলাকা দাপিয়ে বেড়ায় তার দলবল। গত বছরের ২৫শে জুলাই আলম হত্যা মামলার আসামি দুরুল হোদাকে কুপিয়ে হত্যা করে আশরাফ বাহিনীর লোকজন। আলম হত্যা মামলায় জামিনে বেরিয়ে এসে শ্বশুরবাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল দুরুল হোদা। শ্বশুরবাড়িতে ঢুকে স্ত্রী-সন্তানের সামনে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের কয়েকদিন আগে আশরাফ আলী একটি বিস্ফোরক মামলায় আত্মসমর্পণ করে কারাগারে যান।

অভিযোগ রয়েছে, কারাগার থেকে হুকুম দিয়ে তিনি এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন। দুরুল হত্যার পর আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুস সালামকে টার্গেট করে আশরাফ বাহিনী। গত ২৫শে মার্চ রাতে তার গাড়িতে ককটেল হামলা চালিয়ে হত্যাচেষ্টা করে। গাড়িটিতে পরপর ১০টি ককটেল নিক্ষেপ করে সন্ত্রাসীরা। তবে সেবার প্রাণে বেঁচে গেলেও বৃহস্পতিবার অতর্কিত হামলায় খুন হন আব্দুস সালাম। তার সঙ্গে থাকায় নিরীহ স্কুল শিক্ষক আব্দুল মতিনও গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন।

আশরাফের বিরুদ্ধে ২১ মামলার রেকর্ড: পিসিপিআরে (আগের অপরাধের খতিয়ান) আশরাফের বিরুদ্ধে ২১টি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। পরিচিতিতে লেখা হয়েছে, ত্রাস/সন্ত্রাস সৃষ্টিকারী, হত্যাকারী ও অন্যান্য মামলার আসামি। ২১ মামলার মধ্যে ১২টি বিস্ফোরক আইনের, দুটি হত্যা, তিনটি ছিনতাই, দুটি প্রতারণা, একটি মাদক ও আইনশৃঙ্খলা বিঘ্ন ঘটানোর অপরাধে দ্রুত বিচার আইনেও মামলা রয়েছে তার নামে। পুলিশ অপরাধের খতিয়ান তৈরি করে ২০১৬ সালে যেখানে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তথ্য সংযুক্ত রয়েছে।

ককটেলের জেলায় আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার: চাঁপাইনবাবগঞ্জে রাজনৈতিক আধিপত্য, এলাকার আধিপত্য, পারিবারিক রেষ, ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বে ব্যবহার হচ্ছে ককটেল। তিন দশক ধরে লাল-কালো স্কচটেপ দিয়ে মোড়ানো প্রাণঘাতী ‘ককটেল’ ব্যবহার হচ্ছে সব বিরোধে। ভারত থেকে চোরাইপথে আসা বিস্ফোরক, সঙ্গে পাথরের টুকরা, লোহা, পেরেক ও কাঁচের টুকরো মিশিয়ে বানানো হয় ককটেল। জর্দার কৌটায় ভরে স্কচটেপ জড়িয়ে হাসতে-খেলতে ককটেল বানাতে পারে কারিগররা। এ জেলায় ককটেলই সন্ত্রাসীদের প্রধান অস্ত্র। তবে, গত বৃহস্পতিবার রাতের হামলায় প্রথমবারের মতো আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার হয়েছে। চিকিৎসকরা বলছেন, পিস্তলের গুলিতে নিহত হয়েছেন স্কুলশিক্ষক মতিন আলী।

পুলিশ যা বলছে: চাঁপাইনবাবগঞ্জের পুলিশ সুপার মো. ছাইদুল হাসান জানান, রাতে রাণীহাটি কলেজের সামনে আশ্রয়ণ প্রকল্পের পাশে আবদুস সালামসহ তিনজন বসে ছিলেন। হঠাৎ একদল দুর্বৃত্ত তাদের ওপর হামলা চালালে ঘটনাস্থলেই সালামের মৃত্যু হয়। দুর্বৃত্তরা বন্দুক, বোমা ও ছুরি নিয়ে তাদের ওপর হামলা চালায়। রাণীহাটি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আশরাফ আলীর লোকজন এ হামলা চালিয়ছে বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয় এক প্রত্যক্ষদর্শী। জানতে চাইলে এসপি বলেন, আশরাফের গ্রুপ সম্পর্কে জেনেছি। সব তথ্য যাচাই করা হচ্ছে। হামলাকারীদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। শিবগঞ্জ থানার ওসি সাজ্জাদ হোসেন বলেন, নয়লাভাঙ্গা এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই গ্রুপের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছিল। আবদুস সালাম একপক্ষের নেতৃত্ব দিতেন। এ বিরোধের জেরে তাদের হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সুত্র : মানব জমিন।