গ্রামের সংবাদ ডেস্ক : নতুন মোড় নিচ্ছে ঝিনাইদহ-৪ আসনের এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। প্রতিদিনই নতুন নতুন তথ্য বেরিয়ে আসছে। ফেঁসে যাচ্ছেন ঝিনাইদহ আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা। হত্যাকাণ্ডের মিশন বাস্তবায়নকারী শিমুল ভূঁইয়া রিমান্ডে ডিবির তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন। এ ছাড়া এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত মূলহোতা যাকে বলা হচ্ছে সেই আকতারুজ্জামান শাহীনের বান্ধবী শিলাস্তি রহমান বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। তারা দু’জনে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন। শিমুল ভূঁইয়ার জবানবন্দিতে ঝিনাইদহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের কয়েকজন নেতার নাম সামনে এসেছে। তাদেরকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। গতিবিধিও পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এখন আসামিদের দেয়া তথ্যগুলো যাচাই বাছাই করে দেখছেন।
এরইমধ্যে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সম্পৃক্ততা থাকার কারণে ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ ওরফে বাবুকে শনিবার গ্রেপ্তার করেছে ডিবি। তার আগে তাকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করে ডিবি। সম্পৃক্ততা পাওয়ার পরে তাকে মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা। আদালত ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এমন কিছু তথ্য পাচ্ছে ডিবি যেটি এই হত্যাকাণ্ডের মোড় ঘুরিয়ে দিচ্ছে। বেরিয়ে আসছে হত্যাকাণ্ডের মূল রহস্য, গ্রেপ্তার ও পলাতক আসামিদের পাশাপাশি আর কে কে জড়িত।
একাধিক সূত্র বলছে, আনার হত্যার প্রকৃত রহস্য এখনো উদ্ধার না হলেও ঘুরেফিরে স্বর্ণ চোরাচালন দ্বন্দ্বের পাশাপাশি রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের বিষয়টি সামনে উঠে আসছে। কারণ একাধারে আনার ছিলেন মাঠ পর্যায় থেকে উঠে আসা ওই এলাকার গুরুত্বপূর্ণ নেতা। তিন বারের এমপি। বহু বছর ধরে তিনি জনপ্রতিনিধিত্ব করে আসছেন। এ ছাড়া ওই এলাকার স্বর্ণসহ চোরাচালান ব্যবসা একাই নিয়ন্ত্রণ করে আসছিলেন। সবমিলিয়ে তার পদ, সংসদীয় আসন, ব্যবসা, একক নিয়ন্ত্রণ এসব নিয়ে কিছু মানুষ তার উপর ক্ষিপ্ত ছিল। কারণ ওই এলাকার অধিকাংশ মানুষই চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত। আনারের নিয়ন্ত্রণে থাকার কারণে কেউ সুবিধা করতে পারছিল না। তার সংসদীয় আসনও টানা দখল করে রেখেছিলেন। তার জন্য অন্য কেউ মনোনয়ন পাচ্ছিলেন না। এজন্য তার মৃত্যুর পেছনে অনেকের ক্ষোভ জড়িত। আনারের বন্ধু আকতারুজ্জামান শাহীন তার খুব কাছে থেকেই সবকিছুর খোঁজখবর রাখতো। তার সব বিষয়ে জানতো। তাই মূল পরিকল্পনা শাহীনই করেছিল। শাহীনের চাচাতো ভাই ও শিমুলের ভগ্নিপতি নিহত হওয়ার পেছনেও আনারের সম্পৃক্ততা ছিল বলেও অভিযোগ উঠেছিল।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, আনার হত্যাকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছেন বাবু। হত্যার পরিকল্পনা থেকে শুরু করে সবকিছুতে তার সম্পৃক্ততা মিলেছে। আনার হত্যার পর মিশন বাস্তবায়নকারীদের দুই কোটি টাকা দেয়ার কথা ছিল তার। সঞ্জীবার ওই ফ্ল্যাটে আনারের মুখে চেতনানাশক স্প্রে করার পর তার পোশাক খুলে নগ্ন ছবি তোলা হয়েছিল। এসব ছবি ছাড়াও মিশন বাস্তবায়ন করে তোলা ছবিও ঘাতক শিমুল ভূঁইয়া বাবুর মোবাইলে পাঠিয়েছিল। ছবিগুলো ঝিনাইদহ-৪ আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশী আওয়ামী লীগের শীর্ষ এক নেতাকে দেখানোর জন্য পাঠানো হয়েছিল। ওই নেতাকে ছবি পাঠানোর পর তাকে এও বলা হয়েছিল তার মনোনয়ন কনফার্ম। এই নেতার সম্পৃক্ততার বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে ডিবি। তাকেও যেকোনো সময় গ্রেপ্তার করা হতে পারে। এ ছাড়া আকতারুজ্জামান শাহীনই বাবুকে বলেছিল মিশন বাস্তবায়ন হলে শিমুল ভূঁইয়াকে দুই কোটি টাকা দেয়ার জন্য। শিমুল ভূঁইয়াকে বাবুর মোবাইল নম্বর শাহীনই দিয়েছিল। ওই হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে তাদের মধ্যে একাধিকবার কথা হয়েছে। আনারকে হত্যা করে মরদেহ গুম করে ১৫ই মে শিমুল দেশে ফিরে আসে। ১৬ই মে ওই দুই কোটি টাকার বিষয়েও তাদের মধ্যে কথা হয়েছে। এসব তথ্য পেয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। ১৭ই মে ফরিদপুরের ভাঙ্গার এক্সপ্রেসওয়েতে শিমুল আওয়ামী লীগ নেতা বাবুর সঙ্গে একটি গাড়িতে কথা বলে। আলোচনার মূল বিষয় ছিল দুই কোটি টাকা। তখন বাবু শিমুলকে বলেন, ২৩শে মে তিনি টাকা দিবেন। যদি না দিতে পারেন তবে ২৬শে মে কনফার্ম টাকা দিবেন। কিন্তু আনার হত্যার বিষয়টি জানাজানি হওয়াতে ২২শে মে বাবুসহ অন্যান্য নেতারা আত্মগোপনে চলে যান। তদন্ত কর্মকর্তারা বলেন, শনিবার শিমুল ভূঁইয়ার সাভার এলাকার একটি ভাড়া বাসায় অভিযান চালানো হয়। ওই বাসা থেকে একটি মোবাইল ফোন পায় ডিবি। ওই ফোনে বাবুর সঙ্গে আনার হত্যা নিয়ে শিমুল ভূঁইয়ার কথোপকথনের অনেক তথ্য রয়েছে। কিন্তু বাবু তার ৩টি মোবাইল ফোন হারানো সংক্রান্ত যে জিডি করেছেন সেটি নিজেকে রক্ষা করার জন্য করেছেন বলে জানতে পেরেছে ডিবি। কারণ ওই ফোনগুলো তিনি নিজেই ধ্বংস করেছেন। ফেঁসে যাওয়ার মতো তথ্য থাকায় তিনি সেগুলো ধ্বংস করে দিয়েছেন।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলছে, কলকাতায় উদ্ধার হওয়া মাংস ও হাড়ের ফরেনসিক এবং ডিএনএ পরীক্ষা করে সেগুলো আনারের দেহের কিনা সেটি নিশ্চিত করবে সিআইডি। আনারের মরদেহ শনাক্ত করা এখন এই মামলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেজন্য কাজ করে যাচ্ছেন কলকাতার সিআইডি কর্মকর্তারা। এর বাইরে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তার করা। এই মামলায় এখন পর্যন্ত ১২ জনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৬ জনকে। এর মধ্যে বাংলাদেশে ৪ জন ও কলকাতায় ২ জনকে। বাংলাদেশে গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- শিমুল ভূঁইয়া, তার ভাতিজা তানভীর ভূঁইয়া, শিলাস্তি রহমান ও আওয়ামী লীগ নেতা কাজী কামাল আহমেদ বাবু। তাদের মধ্যে বাবু ছাড়া বাকি ৩ জন আদালতে দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন। কলকাতা জিহাদকে আগেই গ্রেপ্তার করেছে। এ ছাড়া নেপালে পলাতক সিয়ামকেও তারা হেফাজতে নিয়েছে। এর বাইরে পলাতক আসামিরা হলেন- মোস্তাফিজুর রহমান, ফয়সাল আলী সাজি, চেলসি চেরি ওরফে আরিয়া, তাজ মোহাম্মদ খান ওরফে হাজি ও মো. জামাল হোসেন।
এদিকে, গত ২৮শে মে কলকাতার সঞ্জীবা গার্ডেনের সেফটিক ট্যাংক থেকে ঢাকার গোয়েন্দা টিমের তথ্যমতে কিছু মাংসের টুকরো উদ্ধার করা হয়। পরে মাংসের টুকরো ফরেনসিক ল্যাবে পাঠিয়ে পরীক্ষা করে জানা গেছে সেগুলো মানুষের শরীরে মাংস। তবে মাংসগুলো এমপি আনারের কিনা সেটি এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এটি নিশ্চিত হওয়ার জন্য আনারের পরিবারের সদস্যদের শিগগির ডাকা হবে কলকাতায়। ডিএনএ পরীক্ষা করে দেখা হবে নিশ্চিত করা হবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গতকাল সচিবালয়ে নিজ কার্যালয়ে বলেছেন, আনারের মরদেহ শনাক্ত হলে অনেক কিছুই প্রকাশ করা সম্ভব হবে। সত্যের খুব কাছাকাছি বলে এসেছি। ডেডবডিটা সুনিশ্চিত হলেই অনেক কিছু প্রকাশ করতে পারবো। সূত্র : মানব জমিন।
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ আব্দুল মুননাফ, মোবাইল : ০১৭১১ ৩৫৯৬৩১, ইমেইল: gsongbad440@gmail.com, IT Support: Trust Soft BD
Copyright © 2024 gramer songbad. All rights reserved.