নিজস্ব প্রতিবেদক : প্রচণ্ড গরমের কারণে গেল সপ্তাহে দেশের বিভিন্ন স্থানে কয়েকবার রেললাইন বেঁকে গেছে। যে কারণে ট্রেনের স্বাভাবিক চলাচল ব্যাহত হয়েছে। চলমান তাপপ্রবাহের মধ্যে রেললাইন বেঁকে যেতে পারে- এমন আশঙ্কা থেকে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়েতে ট্রেন চালনো হচ্ছে ধীরে। এ কারণে কোনো ট্রেনই সময়মতো চলাচল করতে পারছে না।
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়েতে ২,২৮৬ কিলোমিটার রেলপথ রয়েছে। এর মধ্যে শুধু ঢাকা-চিলাহাটি-পঞ্চগড় ও রাজবাড়ী-ঢাকা রুটের রেললাইনে কংক্রিট স্লিপার আছে। আর ঈশ্বরদী-খুলনা রুটে আছে স্টিলের স্লিপার। বাকি পথে আছে প্রায় ৫০ বছরের পুরোনো কাঠের স্লিপার। এর সঙ্গে মাঝেমধ্যে কংক্রিটের স্লিপারও বসানো হয়েছে। তবে কাঠের স্লিপারই বেশি। চলমান তাপপ্রবাহে এসব রেললাইনই বেশি বেঁকে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। কাঠের স্লিপারের কারণে দুর্বল ট্র্যাকে ট্রেনের গতি আনা যাচ্ছে না।
এদিকে, শুক্রবার (২৬ এপ্রিল) পাবনার ঈশ্বরদীতে বাইপাস রেলওয়ে স্টেশনে রেললাইনের পাত বেঁকে যায়। তবে বড় ধরনের দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যায় খুলনা থেকে রাজশাহীগামী আন্তনগর ট্রেন কপোতাক্ষ এক্সপ্রেস।
বেঁকে যাওয়া রেললাইন ধরেই খুলনা থেকে ছেড়ে আসা আন্তঃনগর কপোতাক্ষ এক্সপ্রেস ট্রেনটি রাজশাহীর দিকে যাচ্ছিল। তবে সেটিকে থামিয়ে ঈশ্বরদী লোকোসেডের রেললাইন দিয়ে পেছনে টেনে নেওয়া হয়। এরপর আরেকটি লাইনের মাধ্যমে রাজশাহীর উদ্দেশ্যে প্রায় ১ ঘণ্টা পরে ছেড়ে যায় ট্রেনটি।
পরে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের লোকজন দুই ঘণ্টা ধরে রেললাইনের ওপর পানি ঢেলে তাপমাত্রা কমিয়ে আনার পর বেঁকে যাওয়া রেলপথ স্বাভাবিক করেন।
রেলওয়ের ঈশ্বরদী বাইপাস স্টেশনে কর্মরত স্থানীয় শ্রমিক শুভ হোসেন জানান, কপোতাক্ষ ট্রেন ঈশ্বরদী স্টেশন থেকে ছাড়ার পর ঈশ্বরদী বাইপাস স্টেশনের কাছে যে লাইনে ট্রেনটি আসছিল সেই রেললাইন দূর থেকে দেখে বাঁকা মনে হচ্ছিল। খবর পেয়ে বিভাগীয় রেলের পরিবহন কর্মকর্তা, সহকারি প্রকৌশলীসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে ট্রেনকে পেছনে এনে অন্য রেললাইন দিয়ে কপোতাক্ষ ট্রেন থ্রো পাস করার ব্যবস্থা নেন।
ঈশ্বরদী বাইপাস স্টেশনের স্টেশন মাস্টার তাওলাদ হোসেন জানান, প্রচণ্ড রোদে দুর থেকে দেখে মনে হচ্ছিল অতি তীব্র তাপপ্রবাহে রেললাইন বেঁকে গেছে। এসময় ওই লাইনে খুলনা থেকে ছেড়ে আসা আন্ত:নগর কপোতাক্ষ এক্সপ্রেস ট্রেনটি রাজশাহী যাচ্ছিল। ট্রেনটি থামিয়ে অপর একটি লাইনের মাধ্যমে রাজশাহীর উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়।
তিনি আরও বলেন, পরে রেলওয়ে অফিসের লোকজন রেললাইনের ওপর পানি ঢেলে তাপমাত্রা কমিয়ে আনার পর রেলপথ স্বাভাবিক হয়।
পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে বাণিজ্যিক কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন জানান, খবর পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে গিয়ে ট্রেনটি লাইন থেকে পেছনে এনে অন্য লাইন দিয়ে রাজশাহীতে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন।
এর আগে, গত বৃহস্পতিবারও ঈশ্বরদী-বাইপাস রেললাইনের একটি অংশ বেঁকে যায়। সেদিন দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত এই চার কিলোমিটার রেললাইনে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে।
ঝুঁকি থাকায় এই লাইনে ৪০ কিলোমিটার গতিবেগে ট্রেন চালানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়। এর কয়েক দিন আগে দর্শনা-যশোর রেল রুটে লাইন বেঁকে যাওয়ার আশঙ্কায় ট্রেনের গতি ৬০ কিলোমিটারে নামিয়ে চালানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। এখনও এই রুটটিতে সতর্কতার সঙ্গে ট্রেন চালানো হচ্ছে।
রাজশাহীর বাঘার আড়ানী এলাকাবাসী জানান, অনেক কাঠের স্লিপারই নষ্ট হয়ে গেছে। পর্যাপ্ত পাথর না থাকায় ওই স্লিপার নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। তাছাড়া নাট-বল্টু ও ক্লিপ নড়বড়ে অবস্থায় রয়েছে। অনেক দিনের পুরোনো এই স্লিপার। এর ওপর দিয়েই ঝুঁকি নিয়ে চলছে ট্রেন। রাজশাহীর পবা উপজেলার হরিয়ান এলাকায় গিয়েও রেললাইনে স্লিপারের একই অবস্থা দেখা গেছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, অনেক দিন ধরেই এসব এলাকায় রেললাইনে বড় কোনো সংস্কার দেখা যায় না। নাট-বল্টু খুলে গেলে কিংবা ট্রেন লাইনচ্যুত হলে তখন সংস্কার করা হয়।
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান প্রকৌশলী আসাদুল হক বলেন, “১৯৭৩ সালে রাজশাহী থেকে আব্দুলপুর পর্যন্ত রেললাইন স্থাপন করা হয়। একটি রেললাইনের আয়ুষ্কাল ধরা হয় ২০ থেকে ২৫ বছর। কিন্তু এই স্লিপার ও রেললাইনের বয়স ৫০ পেরিয়ে গেছে। ফলে ট্রেন চালাতে স্বাভাবিকভাবেই সতর্ক থাকতে হচ্ছে। কারণ, প্রচণ্ড তাপপ্রবাহের কারণে কাঠের স্লিপারের লাইনেরই বেঁকে যাওয়ার ঝুঁকি বেশি।” তবে রেললাইনের রক্ষণাবেক্ষণে নিয়মিত কাজ চলছে বলে দাবি তার।
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আহসান জাবির বলেন, “মাত্রাতিরিক্ত গরম বা শীতে লাইন বেঁকে বা ফেটে যায়। এমন লাইনগুলোতে রেলের গতি কমিয়ে আনা হয়। এ অবস্থায় রেল কীভাবে চলবে তার একটি গাইডলাইন আছে। সে অনুযায়ী এখন ট্রেন চালানো হচ্ছে। পাশাপাশি রক্ষণাবেক্ষণের কাজও চলছে।”
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক অসীম কুমার তালুকদার বলেন, “বাইরের তাপমাত্রার চেয়ে রেললাইনের তাপমাত্রা সব সময় সাত থেকে আট ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেশি হয়। প্রচণ্ড তাপপ্রবাহের কারণে কাঠের স্লিপার এলাকার রেললাইন বেঁকে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। তবে এখনও বড় ধরনের কোনো সমস্যা হয়নি। ঈশ্বরদীতে আগে থেকে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ চলছিল। তাই সেখানে রেললাইন বেঁকে যায়। পরে মেরামত করা হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “কংক্রিট স্লিপার অনেক বেশি লোড নিতে পারে। তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পার হলেও লাইন বেঁকে যায় না। কাঠের স্লিপারে তা সম্ভব না। কিন্তু স্লিপার স্বল্পতার করণে মেইন লাইনে কাঠের ও স্টিলের স্লিপার বসাতে বাধ্য হই। এখন আমাদের চেষ্টা আছে যেন পরিবর্তনের সময় কংক্রিটের স্লিপারই বসানো যায়। কাজটা একবারে করতে পারলে ভালো। তাহলে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার ঘটনা কমে আসবে। ট্রেনও গতিতে চালানো যাবে।”
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ আব্দুল মুননাফ, মোবাইল : ০১৭১১ ৩৫৯৬৩১, ইমেইল: gsongbad440@gmail.com, IT Support: Trust Soft BD
Copyright © 2024 gramer songbad. All rights reserved.