গ্রামের সংবাদ ডেস্ক : দেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রায় আট হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ বাতিল করলেও প্রতারণা বা মিথ্যা তথ্য দিয়ে সনদ নেওয়ার অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়নি। এমনকি তাদের মধ্যে যারা সরকারি ভাতা গ্রহণ করেছে সেই টাকাও ফেরত আনার কোনো কার্যকর উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন যারা ভাতা পেতেন সেটা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে তবে এই বিষয়ে মামলা করলে হাজার হাজার লোকের বিরুদ্ধে করতে হবে। তিনি বলেন, ‘আমরা মন্ত্রণালয় চালাবো নাকি আদালতের বারান্দায় বারান্দায় দৌঁড়াবো।’
মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল আহাদ চৌধুরী বলছেন মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও যারা ভুয়া তথ্য দিয়ে এ তালিকায় এসে বেনিফিট নিয়েছে তারা শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছে এবং এদের কাছ থেকে ভাতার টাকা সরকারের ফিরিয়ে আনা উচিত।
জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল বা জামুকার সদস্য মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) ওয়াকার হাসান বলছেন এ বিষয়ে কাউন্সিলের মিটিংয়ে আলোচনা হয়েছে এবং এ টাকা ফিরিয়ে আনার বিষয়ে চিন্তা ভাবনা চলছে। তিনি বলেন, ‘আমরা একটা উদ্যোগ নিচ্ছি। প্রক্রিয়াটা কী হবে বা কীভাবে হতে পারে তা নিয়ে একটা পলিসি ঠিক করতে হবে আমাদের।’
মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়ন, সনদ দেওয়া বা ভুয়া সনদ বাতিলের জন্য এ প্রতিষ্ঠানটিই সরকারকে সুপারিশের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত, যার নেতৃত্বে আছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী নিজেই।
মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী দেশে গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১ লাখ ৮৩ হাজারের সামান্য বেশি। তবে এর মধ্যে এখন বেঁচে আছেন প্রায় এক লাখ।
বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধা তালিকা নিয়ে বিভিন্ন সময় নানা ধরনের অনিয়মের অভিযোগ শোনা গেছে। এমনকি বাংলাদেশে ভুয়া বা অ-মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ঠিক কত, সে বিষয়ে এখনও পরিষ্কার তথ্য নেই মন্ত্রণালয়ের কাছে।
৮ হাজার সনদ কীভাবে বাতিল হলো
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক জানিয়েছেন জামুকা বিভিন্নভাবে যাচাই বাছাই করে নিশ্চিত হয়ে এসব সনদ বাতিলের সুপারিশ করেছে।
মন্ত্রী বলেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা নামগুলো যাচাই বাছাই শেষে মুক্তিযোদ্ধা জাতীয় কাউন্সিলে পাঠান। তারপর মুক্তিযোদ্ধাদের গেজেট প্রকাশ করা হয়। প্রমাণ হওয়ায় ভুয়া আট হাজার জনকে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।’
একই বক্তব্য মন্ত্রী বুধবার মেহেরপুরে মুজিবনগর দিবসের সমাবেশের আগে স্থানীয় সাংবাদিকদেরও দিয়েছেন। তিনি তখন আরও বলেছিলেন, যদি কোনো ব্যক্তি মিথ্যা তথ্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হয়ে থাকে সে বিষয়ে কেউ অভিযোগ করলে বা মন্ত্রণালয়ের নজরে এলে যাচাই করে সেগুলো বাতিল করে দেয়া হবে।
যদিও ২০২১ সালের ৪ঠা সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে মন্ত্রী নিজেই জানিয়েছিলেন যে ২০০২ সাল থেকে ২০১০ সালের মধ্যে যেসব নাম মুক্তিযোদ্ধাদের বেসামরিক গেজেটে প্রকাশিত হয়েছিলো তার মধ্য থেকে প্রায় দশ হাজার বেসামরিক গেজেট বাতিল করা হয়েছে। একইসঙ্গে তখন তিনি জানিয়েছিলেন যে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নাম অন্তর্ভুক্তি এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিদের নাম বাতিল সংক্রান্ত যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া চলমান আছে।
তবে জামুকার কর্মকর্তারা বলছেন সরকার ২০১৪ সালে আগে যেসব মুক্তিযোদ্ধাদের নাম তালিকায় আসেনি তাদের আবেদনের সুযোগ দিলে সারাদেশে অসংখ্য আবেদন জমা পড়ে। এমনকি সরকারের কয়েকজন মন্ত্রীও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নাম তালিকাভুক্তির আবেদন করেন।
তবে ২০১৪ সালেই পাঁচজন সচিবের মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল করে সরকার, যা ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। তখন সনদ বাতিলের পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেছিলো দুর্নীতি দমন কমিশন।
যদিও দেশে প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কত তা নিয়ে অস্পষ্টতা রয়েই গেছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ২০২১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অপূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করেছিলো সরকার যেখানে ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৩৭ জনের নাম ছিল।
মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) ওয়াকার হাসান বলছেন ২০১৪ সালে নতুন নেয়া আবেদনগুলো ২০১৫-১৬ সালের দিকে যাচাই বাছাইয়ের কাজ শুরু হয়।
ওয়াকার হাসান বলেন, ‘অন্তত ২০ শতাংশ আবেদন আমরা বাতিল করে দিয়েছিলাম। এমনকি মন্ত্রীর আবেদনও গ্রহণ করিনি নির্ভরযোগ্য প্রমাণ না পাওয়ায়। বাতিল করেছিলাম কয়েকজন সচিবের সনদ। সব মিলিয়ে আমরা হিমশিম খাচ্ছিলাম।’
ভুয়া সনদের শাস্তি আর ভাতার টাকা ফেরত আসবে?
ভুয়া সনদের শাস্তি কিংবা ভাতা ফেরতের বিষয়ে সরাসরি কোনো জবাব দেননি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী। তবে অনেক বছর ধরেই মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অংশ এ নিয়ে ক্ষোভ বা অসন্তোষ প্রকাশ করে আসছিলেন। আবার এই আট হাজারের মধ্যে কতজন ভাতা তুলেছেন এবং তাদেরকে কত টাকা ভাতা দেয়া হয়েছে সে সম্পর্কিত কোনো তথ্যও পাওয়া যায়নি।
মুক্তিযোদ্ধা সংসদে তিন দফায় চেয়ারম্যান থাকা আব্দুল আহাদ চৌধুরী বলছেন, যারা ভুয়া সনদ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম উঠিয়েছিলো তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি তাদের মধ্যে যারা ভাতা পেয়েছে তাও ফেরত আনা উচিত।
আব্দুল আহাদ চৌধুরী বলেন, ‘এরপর বের করতে হবে ভুয়া সনদধারীদের কারা মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় আসার সুযোগ করে দিয়েছে। তাদেরকেও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও ভুয়া সনদধারীদের দেয়া বেনিফিট ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা উচিত সরকারের।’
জামুকার সদস্য ওয়াকার হাসান বলছেন, ইতোমধ্যেই জামুকার বৈঠকে বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। তিনি বলেন, ‘টাকা ফেরত আনার লক্ষ্য আছে। আমরা একটা উদ্যোগ নিবো। কিন্তু কীভাবে হবে সেটা আলোচনা করে ঠিক করতে হবে। একটা পলিসি নিতে হবে।’
যদিও আগে বিভিন্ন সময়ের যখন তালিকা কিংবা ভাতা নিয়ে বিতর্ক হয়েছে তখন যারা ভুয়া সনদ দিয়ে তালিকায় ঢুকে ভাতা নিয়েছেন তাদের কাছ থেকে টাকা আদায়ে ‘সরকারি পাওনা আদায় আইন–১৯১৩’ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার ইঙ্গিত দিয়েছিলো মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
২০১৪ সাল থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা দেওয়া শুরু করে সরকার। প্রথমে ২০ হাজার জন মুক্তিযোদ্ধাকে মাসে পাঁচ হাজার টাকা করে ভাতা দেয়া হতো, যা পরে বিভিন্ন সময় বাড়ানো হয়েছে।
এখন মুক্তিযোদ্ধারা মাসে ২০ হাজার টাকা করে সম্মানী পান। সম্প্রতি এ টাকা ত্রিশ হাজারে উন্নীত করার জন্য অর্থমন্ত্রীর কাছে প্রস্তাব দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। মুক্তিযোদ্ধারা সরকারি চাকরিজীবী হলে এখন দুই বছর বেশি চাকরি করার সুযোগ পাচ্ছেন।
এছাড়া ক্ষেত্রবিশেষে চিকিৎসা, আবাসন ও রেশনসহ নানারকম সুযোগ সুবিধা আছে। এসব সুবিধা পেতে অনেকেই এখন মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় আসতে চান বলে অভিযোগ আছে। -বিবিসি
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ আব্দুল মুননাফ, মোবাইল : ০১৭১১ ৩৫৯৬৩১, ইমেইল: gsongbad440@gmail.com, IT Support: Trust Soft BD
Copyright © 2024 gramer songbad. All rights reserved.