নিজস্ব প্রতিবেদক : জীবিকার তাগিদে রাজধানীতে কোটি মানুষের বসবাস। কেউ গ্রামে পরিবার-পরিজন রেখে, কেউ আবার কাছের স্বজনদের সঙ্গে নিয়েই সংসার সাজান ইট-পাথরের রাজধানীতে। শ্রম, ঘাম মুছে প্রশান্তির আশায় প্রতিটি দিন মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়েই ঘুমোতে যেতে হয় শহরের বাসিন্দাদের। ব্যস্ত শহরে ছোট বড় প্রতিটি রাস্তার দু’ধারে গিজ গিজ করা ভবনে মৃত্যুর শঙ্কা নিয়েই জীবনের পিছু ছুটে চলা যেন এই শহরের নিয়তি। পুরান ঢাকার নিমতলী, চকবাজারের চুড়িহাট্টা, বনানীর এফআর টাওয়ার, কড়াইল বস্তি, পল্লবী বস্তি, বঙ্গবাজার, নিউমার্কেট, গুলশান সিটি কর্পোরেশন মার্কেট, অতি সম্প্রতি কারওয়ান বাজার বস্তি থেকে সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার রাতে বেইলি রোডের গ্রিণ কোজি কটেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড এই শহরের বিপর্যয়ের এক একটি উপখ্যান। যেন এক একটি মৃত্যুর মিছিল। প্রতিটি ঘটনার পর মিডিয়া-টেলিভিশন, পত্রপত্রিকায় উঠে আসে নানা বিশ্লেষণ। উঠে আসে অনিয়মের শত ফিরিস্তি। কিছুদিন পর সবাই ভুলে যায়। একটি ঘটনা আরেকটি ঘটনাকে ভুলিয়ে দেয়। এভাবে ট্রাজেডির পর ট্রাজেডি হলেও মানুষের হাতে গড়ে ওঠা শহরটা মানুষের জন্যই দিন দিন আরও বেশি অনিরাপদ হয়ে হয়ে উঠছে। শত শত মায়ের বুক খালি হলেও এর দায় নিতে চায় না কেউ। ক্ষোভ, আক্ষেপ, হতাশা, নিরাশার মাঝে ব্যবস্থা, শাস্তি, ক্ষতিপূরণ আর আশার বাণীর মধ্য দিয়ে হারিয়ে যায় প্রাণের অস্তিত্ব। আবার ব্যস্ত হয়ে যায় যে যার মতো। অনিয়মগুলোও চলতে থাকে অবলীলায়, দেদারসে। অথচ অনিয়মের ফলে একের পর এক দুর্ঘটনায় বলি হয় খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। পরিবারের উপার্জনের সম্বল কিংবা স্বজন হারিয়ে নিবৃতে চোখের পানি ফেলা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না কারো। এভাবে অনিরাপদÑঅস্বাভাবিক মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়েই প্রতিটি ভোরে আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে বাকিরাও চষে বেড়ায় রাজধানী ঢাকার অলিগলি। ব্যস্ততার শেষ হয় না রাতের গভীর অবধি। কখনো কখনো আলো ঝলমলে রাতেই নেমে আসে নির্মম ঘুটঘুটে অন্ধকার। বৃহস্পতিবার এমনি একটি নির্মম কালো রাত দেখল রাজধানীবাসী।
বৃহস্পতিবার রাত পৌনে দশটার দিকে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ ভিআইপি এলাকা বেইলি রোডের গ্রিণ কোজি কটেজ ভবনের নিচতলার একটি কফি শপ থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। মুহূর্তেই আগুনের লেলিহান শিখা ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। ঘটনার ভয়াবহতা বিবেচনায় শুরু থেকেই ফায়ার সার্ভিসের ৮টি ইউনিট আগুন নেভাতে কাজ শুরু করে। এরপর আরও কয়েকটি ইউনিট যুক্ত হয়। প্রায় দুই ঘণ্টার টানা প্রচেষ্টায় আগুন নেভাতে সক্ষম হয় ফায়ার সার্ভিসের জানবাজ কর্মীরা। কিন্তু ততক্ষণে ৪৬টি তাজা প্রাণ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। কেউ কেউ শেষ নিঃশ^াসটুকু নিয়ে হাসপাতালের বিছানা পর্যন্ত পৌঁছলেও পরোপারে পাড়ি জমান পোড়া শরীরে। ৭৫ জনকে উদ্ধার করা হয় জীবিত অবস্থায়। স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন জানিয়েছেন, জীবিতদের অবস্থাও শংকটাপন্ন। এদিন রাতে মানুষের হৃদয় পোড়া গন্ধে ঢাকার এই অভিজাত এলাকার আকাশ-বাতাস বাড়ি হয়ে ওঠে। প্রায় অর্ধশত মানুষের স্বপ্ন, সাধনা নিমিষেই পুড়ে ছাই হয়ে যায়। সেই সঙ্গে বিষাদের ছায়া নেমে আসে শত শত পরিবারের হাজারো স্বজনের চোখেমুখে।
ঘটনার পর গতকাল শুক্রবার সাংবাদিকদের ব্রিফিংকারে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের ডিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাঈন উদ্দিন জানান, আমিন মোহাম্মদ ফাউন্ডেশন নির্মিত এই ভবনটিতে অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না। প্রতিষ্ঠানটিকে নোটিশও দেওয়া হয়েছিল বলে তিনি জানিয়েছেন। এ ভবনের একটি মাত্র সিঁড়ি এবং ভবনটিতে কোনো ফায়ার সেফটি প্ল্যান্ট ছিল না। যে কারণে ক্ষয়ক্ষতিসহ প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। রাজউকও বলছে, এই ভবনে রেস্তোরাঁর অনুমোদন ছিল না। এ ঘটনায় ক্ষোভ জানিয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। জাতীয় বিমা দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বেইলি রোডে যেখানে আগুন লেগেছে সেখানে কোনো ফায়ার এক্সিট নেই। এসব ভবন নির্মাণে ইঞ্জিনিয়ার এবং মালিকদের গাফেলতি থাকে। এসব ক্ষেত্রে সচেতনতা খুব প্রয়োজন। আমি বারবার অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা বাড়ানোর নির্দেশ দিচ্ছি। কিন্তু সেটা কেউ মানে না।’
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ঢাদসিক) মেয়র ব্যরিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেছেন, ‘রাজধানীতে ভবন নির্মাণে ইমারত বিধিমালাগুলো ন্যক্কারজনকভাবে লঙ্ঘন করা হচ্ছে। এ বিষয়ে পর্যাপ্ত তদারকি হচ্ছে না। বিভিন্নভাবে নকশা অনুমোদন করা হচ্ছে। কিন্তু সেসব নকশায় ইমারত বিধিমালা মানা হচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, অনেক ক্ষেত্রে নকশা ঠিক থাকলেও যখন ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে, তখন অনিয়ম করা হচ্ছে।’
এই ঘটনায় ভবনের যে প্রতিষ্ঠান থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা হয়েছিল সেই প্রতিষ্ঠানের কয়েকজনকে আটক করেছে পুলিশ। এছাড়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে, ঘটনা খতিয়ে দেখতে। রাজধানী উন্নয় কর্তৃপক্ষ রাজউকও ৭ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি করেছে। প্রত্যেক দুর্ঘটনার পর এমন কমিটি হয়। কিন্তু এর ফলাফল কী হয় তা অজনাই থেকে যায়। দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ পূর্বের ঘটনায় দোষীদের শাস্তি, বিপর্যয় রোধে ভবিষ্যতের জন্য করা সুপারিশ ও প্রত্যাশার সমস্ত বাণী কিছুদিন পর কেন যেন আঁধারে হারিয়ে যায়।
সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে বারবার সতর্কতার কথা বলা হলেও কেন মানা হচ্ছে না প্রয়োজনীয় নির্দেশনা? ‘কারা কিসের বলে সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষা করছে’, ‘তদারককারী সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো কী করে’, ‘ঘটনার পরই কেন তারা নড়েচড়ে বসে’, ‘মুনাফালোভী অপরাধীরা মানুষের জীবনের পরোয়া না করেই কীভাবে নিজেদের বাণিজ্য চালিয়ে যায়’, এমন অসংখ্য প্রশ্ন ঘুরপাক খায় প্রতিটি মৃত্যু মিছিলের পর। এই মৃত্যুর দায় কার? কেউ নিতে চায় না। কেন নিতে চায় না তার কোনো উত্তর নেই।
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ আব্দুল মুননাফ, মোবাইল : ০১৭১১ ৩৫৯৬৩১, ইমেইল: gsongbad440@gmail.com, IT Support: Trust Soft BD
Copyright © 2024 gramer songbad. All rights reserved.