নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজনৈতিক উত্তাপের আগুনে এবার ঘি ঢেলেছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা। বুধবার তফসিল দেয়ার পর থেকে এ ইস্যুতে গত দুদিন ধরে অস্থিরতা আরও বেড়েছে। এ সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দেওয়া বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো তফসিল প্রত্যাখ্যান করে হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচি নিয়ে মাঠে রয়েছে। আর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাদের মিত্ররা আনন্দ মিছিল করছে। এ অবস্থায় দেশজুড়ে ঘটছে বিক্ষিপ্ত সহিংসতা, জ্বালাও পোড়াও। মানুষের মনে আছে উৎকন্ঠা, নানা অনিশ্চয়তা। এসব শঙ্কা ছাপিয়েও সাধারণ মানুষ বলছেন- সব দল ভোটে আসলে ভালো হয়, নিরপেক্ষ হয়।

তফসিল ঘোষণা ও ভোটের পরিবেশ নিয়ে ঢাকা টাইমস কথা বলেছে নির্বাচনী পর্যবেক্ষক এবং বিশ্লেষকদের সঙ্গে। এদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার শাহনেওয়াজ, ব্রতী’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন মুরশিদ, বাংলাদেশের বেসরকারি নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থা জানিপপ- চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান। তাদের কেউ বলছেন, এই মূহুর্তে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি, সব অগোছালো। মানুষকে নির্বাচনি প্রক্রিয়া থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। কেউ বলছেন, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে ইসির হাতে বিকল্প ছিল না। সুযোগ ছিল না তফসিল পেছানোর।

এদিকে রাজনৈতিক বিভেদ-মতভেদ ও সংকট নিরসন না করে বা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড (সব দলের সমান অধিকার) নিশ্চিত না করে তফসিল ঘোষণা নিয়ে প্রশ্নও তুলেছেন অনেকে। বলছেন-এত অস্থিরতার মধ্যে তাড়াহুড়ো করে কেন তফসিল? ইসি কি সংলাপ বা আলোচনার ব্যবস্থা করে রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতা নিশ্চিত করতে পারতো না? নাকি তারা চায়নি? লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড যারা তৈরি করতে পারেনি- তারা সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ ভোট নিশ্চিত করবে কীভাবে?

অন্যদিকে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, আন্তর্জাতিক চাপ ও সকল জল্পনা-কল্পনা ছাপিয়ে অবশেষে ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। টানা ৩ মেয়াদে ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ। তবে সংসদের বিরোধীদল জাতীয় পার্টি এবং রাজপথে আন্দোলনকারী দল বিএনপির সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের কোনো ধরনের আলোচনা বা সংলাপের মাধ্যমে সংকট নিরসন ছাড়াই নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচন বিষয়ক প্রতিক্রিয়া জানতে অন্তত ২০ জন নাগরিকের সঙ্গে কথা বলেছে ঢাকা টাইমস। তাদের বেশিরভাগই ভোটের প্রতি আগ্রহ হারানোর কথা জানিয়েছেন। কেউ বলেছেন ভয় আর শঙ্কার কথা। আবার কেউ সম্ভাব্য সহিংসতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তবে সবাই চান, সবার অংশগ্রহণে অবাধ-সুষ্ঠু নিরপেক্ষ শান্তিপূর্ণ ভোট। স্বতস্ফূর্ত ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমেই ঘটুক ক্ষমতার পালাবদল। বাংলাদেশে ভোট যেমন একটি প্রধান রাজনৈতিক উৎসবে পরিনত হতো বিগত বছরগুলোতে, তেমন উৎসব হোক নির্বাচন ঘিরে। তবে যে সরকারই আসুক- তারা চান ভোটাধিকার, চান দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা।

যা বলছেন নাগরিকরা

আসন্ন ভোট নিয়ে কারওয়ানবাজারে কথা হয় ৭৫ বছর বয়সী আব্দুস সালামের সঙ্গে। তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ভোট দিতে পারলে ভালো লাগবে’।

তবে ভোট প্রসঙ্গে বিরক্তি প্রকাশ করেন ৪০ বছর বয়সী একজন ব্যক্তি। ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ভোট দেয়ার ক্ষমতা আমাদের আছে কি না, এটা নিয়েই সন্দেহে আছি। আমার ভোট আরেকজন দিয়া দিলেও সমস্যা নাই। তবে জিনিসপত্রের দাম কমুক।’

সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে নির্বাচন কমিশন প্রস্তুতি নিতে পারতো বলে জানান সিএনজি চালক মোসাদ্দেক। তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘একা (একক দল) নির্বাচন তো আর সুষ্ঠু হয় না। নির্বাচনে একজন ঠকবে আরেকজন জিতবে। ভালো-মন্দ মানুষ বিচার করবে। একা তো আর পাল্লা (প্রতিদ্বন্দ্বীতা) হয় না।’

ভিন্ন কথা বললেন রাজধানীর মিরপুরের ইলেক্ট্রনিক সামগ্রীর ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আলমগীর (৫৫)। তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘একটি পক্ষ দেশে অরাজকতা করতে চাইছে। কিছু করতে পারবে না। যথাসময়ই নির্বাচন হবে।’

তবে নির্বাচন কমিশনের নিজের কিছু করার ক্ষমতা নেই বলে মনে করেন একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, ‘ওপর থেকে সিদ্ধান্ত আসে, তারা (ইসি) শুধু নিজের মুখ দিয়ে ঘোষণা করে।’

আর শাহবাগ মোড়ে এক গাড়ি চালক বললেন, ‘দেখতেছেন না, দেশের পরিস্থিতি কি? আমরা চাইলেই কি কিছু হবে?’

১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতার পর থেকেই, স্বাধীন বাংলাদেশে ভোট একটি প্রধান রাজনৈতিক উৎসব হিসেবে দেখা গেছে। সকল দলের অংশগ্রহণের মাঝেই ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে বারবার। তবে এর আগে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনী পরিবেশ আগের চেয়ে অনেক পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। অর্থাৎ বিগত বছরগুলোতে রাজনৈতিক টানাপোড়েনে নির্বাচন ঘিরে সাধারণ মানুষের আগ্রহ কমে গিয়েছে অনেকটাই।

এমন পরিস্থিতিতে আবারও আসছে জাতীয় নির্বাচন। তফসিল ঘোষণা নিয়ে জনগণের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলেই তাদের মাঝে কথা বলতে না চাওয়ার অনাগ্রহ লক্ষ্য করা যায়।

এই কথোপকথনের মাঝেই পাশ থেকে প্রতিক্রিয়া জানান চাকরিজীবী বরুণ মন্ডল। তিনি বলেন, ‘এখন সরকার পাল্টালে উন্নয়ন বন্ধ হয়ে যাবে। যেভাবে ঘোষণা আসছে, সেভাবে নির্বাচন হয়ে যাওয়াই ভালো।’

৩০ বছর বয়সী মিজানুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশে যতগুলো রাজনৈতিক দল আছে সবাইকে সাথে নিয়ে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলেই সবচেয়ে ভালো। নইলে ভোটের আনন্দ লাগে না। ছোটবেলায় আমরা দেখছি, ভোট আনন্দের, উৎসব। কিন্তু আমি ভোটার হওয়ার পর তা এখনো পাইনি।’

এই নির্বাচন কেমন হবে- জানতে চাইলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ২৮ বছরের তারিফ হোসেন বলেন, ‘এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নাই, নির্বাচন আগের মতোই হবে। নৈতিকতার জায়গায় আমরা অনেক পিছিয়ে পড়েছি। এ থেকে উত্তরণ ঘটতে সময় লাগবে।’

যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা

নাগরিকদের কাছ থেকে পাওয়া প্রতিক্রিয়া তুলে ধরে জানতে চাইলে নির্বাচন বিশ্লেষক ও ব্রতীর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন মুরশিদ ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘মানুষকে নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকে বের করে একেবারে প্রান্তিক করে দেয়া হয়েছে। ফলে মানুষ ভোটের আগ্রহ হারাচ্ছে। এর আগে কখনোই জাতীয় নির্বাচনের আগে এতটা অস্থিতিশীলতা দেখা যায়নি। জাতীয় নির্বাচনের আগে যে কয়টা নির্বাচন হয়েছে সেগুলো প্রমাণ করে লেভেল প্লেইং ফিল্ড নাই, একটা অগোছালো অবস্থা। সবমিলিয়ে একটা বড় রকমের অনিশ্চয়তার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীম উদ্দিন খান ঢাকা টাইমসকে জানান, তফসিল ঘোষণার পর সারাদেশে ক্ষমতাসীন দলের বিজয় মিছিল এমন বার্তা দেয় যেন নির্বাচনের আগেই একটি দল বিজয়ী হয়ে গেছে। এটা সাধারণ মানুষের মাঝে কোনোভাবেই ভালো অনুভূতি তৈরি করে না।

তবে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বশীল ভূমিকাই এই সংকট থেকে মুক্তি দিতে পারতো বলে মনে করেন শারমিন মুরশিদ। তিনি ব্যাখা করে বলেন, সংবিধান অনুযায়ী তফসিল ঘোষণার পর কিন্তু আর বিদ্যমান শাসন ব্যবস্থা নেই। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আর সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। এখন দেশ চালাবে নির্বাচন কমিশন, তারাই সরকার।’

তিনি আরও বলেন, ইসি যদি সকল দলের অংশগ্রহণ ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করতে না পারে, তারা ক্ষমতাসীন দলের কাছে যাবেন। এরপর আওয়ামী লীগ যদি তা না করে তাহলে তারা আদালতে যাবেন। যদি সেখানেও সমাধান না হয়, তারপর আইন সাপেক্ষে নির্বাচন কমিশন বলতে পারেন যে- আমরা এই নির্বাচন করতে পারব না।’ একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের কাছে স্বাধীন বাংলাদেশে এমন প্রত্যাশা থাকাটাই স্বাভাবিক বলে জানান এই বিশ্লেষক।

তবে সাবেক নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের কাছে আর কোনো বিকল্প ছিল না। একটি সরকারের ৫ বছরের মেয়াদ শেষে নির্বাচন কমিশনকে ৯০ দিনের মধ্যেই নির্বাচন করতে হবে। আর মনোনয়ন এবং যাচাই-বাছাইসহ কিছু সময় তো হাতে রাখতে হয়। বিএনপি না আসলেও নির্বাচন আইন অনুসারে হবে।’

আরও জানান, ২০১৪ সালে তিনি যখন দায়িত্বে ছিলেন, তখনও বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিয়ে প্রতিহত করার চেষ্টা করেছিলো। এখন অবরোধ হচ্ছে, অগ্নিকাণ্ড ঘটছে, কে করছে সেটা জানি না। এই অরাজকতা বিরাজ করলে প্রাণহানি ও সম্পদ বিনষ্টের শঙ্কা তো রয়েছেই বলে জানান সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার।

ইসির কাছে আর কোনো বিকল্প ছিল না বলেই একমত বাংলাদেশের বেসরকারি নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থা জানিপপ- চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ। তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন এই তফসিল ঘোষণা না করলে সাংবিধানিক শূন্যতা তৈরি হতো। বলতে পারেন, আরও কয়েকদিন সময় নিতে পারতো। কিন্তু যত দেরি হবে তত কমিশনের নির্বাহী কার্যক্রমের ক্ষেত্র কমে আসবে। যদি প্রয়োজনে কোনো তফসিল ঘোষণা করতে হয়, সেজন্যই তারা হাতে সময় রেখেছেন। সময় ফুরিয়ে যায়নি।’

নির্বাচন ঘিরে আন্তর্জাতিক তৎপরতার বিষয়ে অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান বলেন, বাংলাদেশ নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন, রাশিয়ার সাম্প্রতিক বক্তব্যগুলোতে রাজনৈতিক অস্থিরতা পরিষ্কার। লক্ষ্য করুণ- বিশ্ব রাজনীতির যে মেরুকরণ, প্রতিযোগিতা ও লড়াইয়ের পূর্ণাঙ্গ প্রকাশ ঘটেছে বাংলাদেশের নির্বাচনে। এদেশগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বিতার একটি ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। বিদেশি শক্তিগুলোর প্রভাব বাংলাদেশের রাজনীতিতে আগে থেকেই ছিলো, এই সময়ে সেটা আরও পরিপক্ত হলো। এদের পারস্পরিক স্বার্থ থেকে, বাংলাদেশের আর মুক্তি ঘটবে না, যা খুবই দুর্ভাগ্যজনক।’ সুত্র : ঢাকা টাইমস ।