কক্সবাজার প্রতিনিধি : কক্সবাজারের চকরিয়ায়-মাতামুহুরী নদীতে উজানের পানি ও টানা ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। নতুন করে আরও বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। মঙ্গলবার বিকালে জেলা প্রশাসনের দেয়া তথ্য মতে, জেলায় এ পর্যন্ত ৯টি উপজেলার ৬০টি ইউনিয়নের সাড়ে পাঁচ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। এতে পানিবন্দি মানুষের খাবার ও বিশুদ্ধ পানির চরম সংকট দেখা দিয়েছে। গত দুই দিনে পাহাড় ধস ও পানির স্রোতে ভেসে গিয়ে ও পাহাড় ধসে শিশুসহ দুইদিনে ৫ জন নিহত হয়েছে।
প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে রান্না করা খাবার ও শুকনো খাবার বরাদ্দ দেয়া হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। বর্তমানে চকরিয়া উপজেলার ১৮টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা ও জেলার বিভিন্ন উপজেলার প্রায় ৩ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি রয়েছে। প্লাবিত হচ্ছে আরো নতুন নতুন এলাকা।
স্থানীয় সূত্রে জানাগেছে, চকরিয়ার ফাঁসিয়াখালীর উত্তর ঘুনিয়ায় ভারি বর্ষণ ও উজানের পানির তীব্রতার কারনে ৮ আগস্ট ভোর সকালে ভূমি ধস ও বাড়ির দেয়াল ভেঙ্গে চাপা পড়ে রোজিনা আক্তার (৫০) নামে এক মহিলা নিহত হয়েছে। নিহত রোজিনা ওই গ্রামের আবুল হোসেনের স্ত্রী।
একইদিন দুপুর ১২টার দিকে উপজেলার সাহারবিল ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ড কোরালখালী গ্রামে মোহাম্মদ সেলিম প্রকাশ সেলিম খলিফার ১২ বছরের এক মেয়ে বন্যার পানির স্রোতে ভেসে গিয়ে মৃত্যু হয়েছে। একই পরিবারের আরো একটি মেয়ে পানিতে ভেসে গিয়ে এখনো নিখোঁজ রয়েছে।
এছাড়া আগের দিন ৭ আগস্ট সকালে উপজেলার বরইতলী ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ড সবুজ পাড়া (বরঘোনা) এলাকায় পাহাড় ধসে দেওয়াল চাপা পড়ে দুই শিশু মৃত্যু হয়েছে। নিহত শিশুরা হলো মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনের পুত্র তাবাচ্ছুম (১) ও মোহাম্মদ সাবিদ (৫)।
বরইতলী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ছালেকুজ্জামান মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন। একইদিন সকালে মাতামুহুরী নদীতে লাকড়ি কুড়াতে গিয়ে পানিতে ডুবে শাহা আলম নামের এক ব্যক্তি স্রোতে ভেসে গিয়ে নিখোঁজ রয়েছে। দুইদিনেও তার সন্ধান মেলেনি। শাহ আলম লক্ষ্যারচর হাজী পাড়া এলাকার জাকের হোসাইনের ছেলে।
মাতামুহুরী নদীতে বানের পানির তীব্র স্রোতে ভেঙ্গে গেছে বিএমচর ইউনিয়নের কন্যারকুম বেড়িবাঁধ। ফলে লোকালয়ে ঢুুকে পড়েছে উজানের পানি। গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হচ্ছে। হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
চকরিয়া পৌরসভা ৮ ও ৯নং ওয়ার্ডের বেড়িবাঁধ- শহর রক্ষাবাধ ভাঙ্গন রোধে রাতভর হাজার হাজার মানুুষ বালির বস্তা দিয়ে পাহাড়ায় থাকলেও বেড়িবাঁধ উপচে বানের পানি ঢুকে হাজার হাজার ঘর-বাড়ি ও পৌর শহরের বাণিজ্যিক মার্কেট সমূহ ডুবে গিয়ে শত কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে ব্যবসায়ীদের। বর্তমানে ওই এলাকার সড়ক দিয়ে চলছে নৌকা ও বাঁশের ভেলা দিয়ে যাতায়াত। পৌর এলাকাসহ পুরো উপজেলা জুড়ে দেখা দিয়েছে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট। প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে রান্না করা ও শুকনো খাবার সরবরাহ করা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।
চকরিয়া উপজেলা প্রশাসন থেকে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে মাত্র ২০ মে:টন শুকনো খাবার। বানবাসীর জন্য দুইদিন ধরে রান্না করা খাবার পরিবেশন করে যাচ্ছেন চকরিয়া-পেকুয়া আসনের সংসদ সদস্য উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি আলহাজ্ব জাফর আলম ও পৌরসভার মেয়র আলমগীর চৌধুরী। এছাড়া জামায়াতে ইসলামী কেন্দ্রীয় ফান্ড থেকে বন্যা দূর্গত মানুষের জন্য শুকনো খাবার সামগ্রী পৌছে দিচ্ছেন জামায়াতের মনোনীত সাংসদ প্রার্থী আবদুল্লাহ আল ফারুক। তারা বিভিন্ন দূর্গত এলাকাও পরিদর্শন করেন।
স্থানীয়রা জানান, টানা বর্ষণ অব্যাহত থাকলে পাহাড় ধসে প্রাণঘাতির আরো আশংকা রয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসরত লোকজনকে নিরাপদ আশ্রয়স্থলে সরে যাওয়ার জন্য সতর্কবার্তা জারি করা হলেও ঘর ছেড়ে আসতে চাই না বসবাসরতরা। টানা ভারি বর্ষন ও উজানের পানিতে চকরিয়া পৌরসভাসহ উপজেলার ১৮টি ইউনিয়নের প্রায় দেড় শতাধিক গ্রামের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে বিভিন্ন এলাকার গ্রামীণ সড়কগুলো পানির নিচে তলিয়ে গিয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থাও বিছিন্ন হয়ে পড়েছে।
বিশেষ করে চকরিয়া পৌরসভা, উপজেলার সাহারবিল, পশ্চিম বড়ভেওলা, বদরখালী, কাকারা, সুরাজপুর-মানিকপুর, বরইতলী, হারবাং, চিরিঙ্গা, লক্ষ্যারচর, কৈয়ারবিল বিএমচর, বমুবিলছড়ি ও পূর্ব বড় ভেওলা ইউনিয়ন। এসব গ্রামের নিচু এলাকার সড়কগুলো পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় মানুষ বিকল্প পথ হিসেবে নৌকা ও ভেলায় চড়ে যাতায়ত করছে। এখনো ভারী বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় মাতামুহুরী নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে, টানা কয়েকদিনের ভারি বর্ষনের কারণে দেশের অন্যতম পর্যতন স্পট সাফারী পার্কের সীমানা প্রাচীর ও ড্রেন কালভার্ট ভেঙ্গে পড়েছে।
ডুলাহাজারাস্থ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাফারী পার্কের রেঞ্জ কর্মকর্তা মো: মাজহারুল ইসলাম জানান, প্রাকৃতিক দূর্যোগ অতিবৃষ্টির পানির স্রোতে সাফারি পার্কের তৃণভোজী বেষ্টনীর দক্ষিণ অংশে পূর্ববর্তী বছরের ভাঙ্গার জায়গায় প্রায় ১০০ ফুট সীমানা প্রাচীরসহ পাশ্বনালা, ১টি কালভাট সম্পূর্ণ ধবংস হয়ে গেছে। প্রবল পানির স্রোতে কালভার্টটির গোড়ার মাটি সরে গিয়ে প্রায় ১০ ফুট দেবে গেছে। ফলে তৃণভোজী প্রানি জেব্রা, ওয়াইল্ড বিষ্ট নিরাপত্তা ঝুঁকিতে আছে। স্থানীয় ব্যবস্থাপনায় অস্থায়ী ভাবে ঘেড়া বেড়া দেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে উধর্তন মহলে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে।
চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জেপি দেওয়ান বলেন, পানির তীব্রতা কমাতে ইতোমধ্যে উপকূলের মৎস্য ঘেরের স্লুুইচ গেটগুলো খুলে দেয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসন বন্যা পরিস্থিতির বিষয়ে জানানো হয়েছে। প্রাথমিকভাবে বন্যা দূর্গত এলাকার জন্য ২০ মে:টন শুকনো খাবার বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। আরো বরাদ্দের চাহিদা দেওয়া হয়েছে। উপজেলায় মজুদকৃত চিড়া-গুড়সহ শুকনো খাবার সমূহও বিতরণ করা হচ্ছে। পাহার ধসের বিশেষ বিশেষ স্থান চিহ্নিত করে চেয়ারম্যান-মেম্বারদের মাধ্যমে সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
মাতামুহুরী নদীর ভাঙ্গন ঠেকাতে বেড়িবাঁধ সংলগ্ন এলাকা সমূহে বিশেষ নজরদারী বাড়ানো হয়েছে। এসব এলাকায় চেয়ারম্যান-কাউন্সিলর ও মেম্বারদের সমন্বয়ে সাধারণ জনগনকে সাথে নিয়ে সার্বক্ষনিক মনিটরিং করা হচ্ছে। তিনি অতি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা পরিদর্শনের আওতায় রেখেছেন বলে জানান। জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, জেলায় বন্যা দুর্গত কবলিত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে
কক্সবাজার সদর, ঈদগাঁও, চকরিয়া, মহেশখালী, উখিয়া, টেকনাফ উপজেলা। এসব উপজেলার মোট ৬০ টি ইউনিয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৫৭৬ টি আশ্রয় কেন্দ্র রয়েছে এর মধ্যে ২০৮ টি খোলা রয়েছে।জেলায় অতিবৃষ্টির কারনে সড়ক বিভাগের মোট ৪৬ কি.মি সড়ক বিভিন্ন মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রাস্তা পানিতে ডুবে আছে। পানি নেমে গেলে আর্থিক মূল্য জানা যাবে। এরমধ্যে চকরিয়া-বদরখালী আঞ্চলিক মহাসড়ক (আর- ১৭২) ১ম ৬ কিমি, ইয়াংচা-মানিকপুর-শান্তিবাজার জেলা রোড(জেড- ১১২৬) ১৯ কিমি পুরো অংশ, লক্ষ্যারচর-বেথুয়াবাজার-বাগগুজারা জেলা রোড (জেড-১১২৭) ১১ কিমি পুরো অংশ, একতাবাজার বানৌজা শেখ হাসিনা জেলা সড়ক (জেড-১১২৫) ০.৫ কিমি, বড়ইতলি-মগনামাঘাট সড়ক (জেড-১০০২) ৭ কিমি পুরো অংশ, ৩টি ছোট কালভার্ট ভেঙ্গে গেছে।
কাঁচা রাস্তা ৩ কি.মি চট্টগ্রাম-কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়ক ২.৫ কি.মি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জেলায় ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ৫৮ হাজার মেট্রিক টন চাউল বিতরণ করা হয়েছে আর নগদ টাকা বিতরণ করা হয়েছে ৭ লক্ষ টাকা।
এদিকে বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহিন ইমরান। পরিদর্শনকালে তিনি ক্ষতিগ্রস্তদের বিভিন্ন ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করেন। তিনি সরকারের পক্ষ থেকে সবধরনের সহযোগিতা করার কথা জানান।
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ আব্দুল মুননাফ, মোবাইল : ০১৭১১ ৩৫৯৬৩১, ইমেইল: gsongbad440@gmail.com, IT Support: Trust Soft BD
Copyright © 2024 gramer songbad. All rights reserved.