কক্সবাজার প্রতিনিধি : কক্সবাজারের রেল যোগাযোগ স্থাপন একসময় স্বপ্নই ছিল। কিন্তু পর্যটন নগরী কক্সবাজারে এখন নির্মাণের শেষ প্রান্তে রয়েছে আইকনিক রেলস্টেশন। বন জঙ্গল পাহাড় পেরিয়ে ঢাকা থেকে স্বপ্নের ট্রেন এসে থামবে এই নান্দনিক ঝিনুকের বুকে।

সেইসঙ্গে কক্সবাজারবাসীর শত বছরেরও বেশি সময় ধরে ট্রেনে ওঠার স্বপ্ন পূরণ হবে। আর সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার। আর সরকারের এমন উদ্যোগের ফলে কক্সবাজারের পর্যটনসহ সামগ্রিক অর্থনীতিতে আসবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন- এমনটিই মনে করছেন স্থানীয়রা।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্পের কাজ ৮৬ শতাংশ শেষ হয়েছে। কক্সবাজারের স্টেশনটির কাজও প্রায় শেষ পর্যায়ে। পাঁচ তলা বিশিষ্ট এই স্টেশনে থাকবে শপিং মল, ফুড কর্নার, লকার, কনভেনশন হলসহ ১৭টি বাণিজ্যিক কার্যক্রম। সমুদ্র দর্শনে এসে প্রথম দর্শনেই সামুদ্রিক একটা আবহ পাওয়া যাবে গোটা স্টেশনে। সেপ্টেম্বর মাসে এই রেলপথে ট্রেনের প্রথম ট্রায়াল রান হবে। আর বাণিজ্যিকভাবে আগামী বছরের জুনে ট্রেনের হুইসেল বাজবে কক্সবাজারে।

এতে কম সময়ে, কম খরচে আরামদায়কভাবে যাতায়াত করতে পারবেন এই অঞ্চলের মানুষ। ফলে কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পে বইছে সম্ভাবনার সুবাতাস। দেশের অর্থনীতির গতি বাড়বে বহুগুণ। হবে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা।

দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে মিয়ানমারের অদূরে গুমদুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্পের কাজ ২০১০ সালে হাতে নেয় সরকার। দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ শেষ হবে ২০২৪ সালের জুনে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় হচ্ছে ১৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। দুই পর্যায়ে এই প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ দশমিক ৮৩১ কিলোমিটার সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মাণ করা হবে। আর এই অংশেরই ৮৬ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।

দ্বিতীয় পর্যায়ে রামু থেকে মিয়ানমারের অদূরে গুমদুম পর্যন্ত ২৮ দশমিক ৭৫২ কিলোমিটার সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মাণ করা হবে।

পরবর্তীতে এটি ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে করিডরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করবে। পর্যটন শহর কক্সবাজারকে রেলওয়ে নেটওর্য়াকের আওতায় আনতে, পর্যটক ও স্থানীয় জনগণের জন্য নিরাপদ, আরামদায়ক, সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রবর্তন এবং সহজে ও কম খরচে মাছ, লবণ, রাবারের কাঁচামাল এবং বনজ ও কৃষিজ দ্রব্যাদি জানতে চাইলে দোহাজারী-কক্সবাজার রেল লাইন প্রকল্পের অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক আবুল কালাম চৌধুরী বলেন, এ প্রকল্পের ৮৬ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে, সামান্য কিছু কাজ বাকি আছে। আশা করছি, সেপ্টেম্বরের ১৫ থেকে ৩০ তারিখের মধ্যে চট্টগ্রাম তথা ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত একটি ট্রায়াল রান করা হবে। বাণিজ্যিকভাবে ট্রেন চালু হতে কয়েক মাস সময় লাগবে।

প্রাথমিকভাবে দুই জোড়া ট্রেন চলবে। পরে ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানো হবে। ঢাকা থেকে যে-সব ট্রেন চট্টগ্রাম পর্যন্ত আসে, সেসব ট্রেনের শেষ গন্তব্য হবে কক্সবাজার। এছাড়া সম্পূর্ণ নতুন একটি ট্রেন চালু হবে। কুয়েত থেকে নতুন কোচ আনা হয়েছে। তবে এখনো ট্রেনের নাম নির্ধারণ করা হয়নি।

তিনি বলেন, ট্রেন চালু হলে ঢাকা থেকে কক্সবাজার আসতে সাড়ে ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা লাগবে। এসি সিটের ভাড়া ১২০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। আর নন এসি হতে পারে ৭০০ টাকা।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রকল্প নির্মাণে হাতি ও অন্যান্য বন্যপ্রাণীর নির্বিঘ্নে চলাচল করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। দোহাজারী থেকে কক্সবাজারের দূরত্ব ১০০ কিলোমিটার। বর্তমানে দোহাজারী পর্যন্ত রেললাইন আছে। এ কারণে দোহাজারী থেকে রামু হয়ে বন-পাহাড় নদী পাড়ি দিয়ে রেলপথটি যাচ্ছে কক্সবাজারে। নয়টি স্টেশন নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ।

এর মধ্যে আছে দোহাজারী, সাতকানিয়া, লোহাগড়া, হারবাং, চকরিয়া, ডুলাহাজরা, ইসলামাবাদ, রামু ও কক্সবাজার। এসব স্টেশনে থাকবে কম্পিউটার বেইজড ইন্টারলক সিগন্যাল সিস্টেম এবং ডিজিটাল টেলিকমিউনিকেশন সিস্টেম। দোহাজারী থেকে চকরিয়া এবং চকরিয়া থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথে ৩৯টি ব্রিজ ও আন্ডারপাস সহ ২৫১টি কালভার্ট নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। ইতোমধ্যে ৮১ কিলোমিটার অংশে রেলওয়ে ট্র্যাক বসানো হয়েছে।

আইকনিক এই রেলস্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, নান্দনিক ডিজাইন আর নির্মাণশৈলীতে গড়ে উঠছে স্টেশনটি। চারদিকে গ্লাস বসানো হয়েছে। ছাউনিটা পুরো কাঠামোকে ঢেকে রেখেছে। ওপরের ছাদ খোলা থাকায় থাকবে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা। দিনের বেলা বাড়তি আলো ব্যবহার করতে হবে না এই রেলস্টেশনে। ফলে সবসময় ভবনটি সহনীয় তাপমাত্রায় থাকবে। স্টেশনটির ছাদ ঝিনুক আকৃতির। সামনে ফোয়ারা বসানোর কাজ চলছে, সেখানো মুক্তা বসানো হবে। ৬টি লিফট ও ২টি চলন্ত সিঁড়ি স্থাপনের কাজ করছেন শ্রমিকরা।

সুবিশাল এই চলন্ত সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোতলা থেকে নামতে হবে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে। আর আসার যাত্রীরা বের হবেন নীচ থেকে। স্টেশনের ভেতরেই থাকবে কেনাকাটার ব্যবস্থা। থাকবে হলরুম। আবার চাইলেই নির্দিষ্ট লকারে ব্যাগ রেখে পর্যটকরা ঘুরে আসতে পারবেন পুরো শহর। এমন ৫০০টি লকার থাকবে। থাকবে হোটেল ও গোসলখানা।

তবে চালু হওয়ার আগেই নান্দনিক এই স্টেশনটি দেখতে আসছেন পর্যটকরা। তারা বলছেন, দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন চালু হলে গতি বাড়বে দেশের অর্থনীতির চাকার। সেই সঙ্গে তুলনামূলক চাপ কমবে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের ওপর। কক্সবাজারের পর্যটনশিল্পের আমূল পরিবর্তন ঘটবে। কারণ তখন সহজেই কক্সবাজারে পর্যটকের আগমন বাড়বে। চাঙা থাকবে পর্যটন ব্যবসা। নতুন করে বাড়বে স্থানীয় কর্মসংস্থান।

নবনির্মিত কক্সবাজার আইকনিক রেলস্টেশনের সামনে কথা হয় নগরীর বাহারছড়ার বাসিন্দা আব্দুল কুদ্দুসের সঙ্গে। মহেশখালী থেকে আসা এক বন্ধুকে নিয়ে স্টেশন দেখতে এসেছিলেন তিনি। আব্দুল কুদ্দুস বলেন, ‘কক্সবাজারে রেলওয়ে হওয়ার ফলে আমাদের ব্যবসা বাণিজ্য বাড়বে। এটি কক্সবাজারবাসীর জন্যে আলাদা সুবিধা তৈরি করবে। সবাই খুব খুশি। রেলপথ হচ্ছে, পর্যটক বেশি আসবে। ব্যবসা বাণিজ্য বাড়বে। এজন্যে কক্সবাজারবাসী হিসাবে সবাই সরকারকে ধন্যবাদ দিচ্ছে।

এই বীচের পাড়েই চায়ের দোকান রয়েছে শফিক আহমেদের। রেল যুগের নতুন দিগন্তের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সব মিলিয়ে আগের চেয়ে বেশি মানুষ কক্সবাজারে আসবে। এতে সুবিধা হবে সকলের। প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরও জানা যায়, ২০১৮ সালের ১ মার্চ চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের কাজ শুরু হয়; আগামী জুনে কাজ শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু নির্ধারিত মেয়াদের প্রায় ১০ মাস আগে প্রকল্পের কাজ শেষ হচ্ছে। তবে অনেক আশার মধ্যেও কিছু হতাশা রয়েছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলওয়ে নির্মাণ প্রকল্পে; কিছু স্থানে ক্ষতিগ্রস্তরা ঠিকাদারদের নির্মাণকাজে বাধা দিচ্ছে। আর কিছু কারণে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলা প্রশাসন থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া সম্ভব হয়নি।

প্রকল্প প্রণয়নের উদ্যোগ শুরু হয় ২০১০ সালের জুলাইয়ে। এরপর নানা প্রক্রিয়া শেষ করে প্রকল্পের কাজ শেষ হচ্ছে আগামী সেপ্টেম্বরে। যদিও আগামী জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ রয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে মিয়ানমার, চীনসহ ট্রান্স এশিয়া রেলওয়ে করিডরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা হবে। বড় বিষয় হলো পর্যটন শহর কক্সবাজার রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আওতায় আসবে। এর ফলে পর্যটকদের চলাচল সহজ হওয়ার পাশাপাশি মাছ, লবণ, রাবার তৈরির কাঁচামাল, বনজ ও কৃষিজাত পণ্য সহজে ও কম খরচে পরিবহন করা যাবে।