সানজিদা আক্তার সান্তনা : আজ বাদে কাল পালিত হবে ঈদুল আজহা। ঈদ হচ্ছে সম্প্রীতি ও আনন্দের উৎসব। ধর্মীয় রীতি-নীতি ও আনন্দ ভাগাভাগি করার পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি মেনে এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে আমাদের ঈদুল আজহা উদযাপন করতে হবে।
ঈদুল আজহা'র আনন্দের প্রধানতম হলো খাবার। অন্যান্য খাবারের সঙ্গে মূল আয়োজনে থাকে হরেক রকমের গােস্তের পদ যেমন-গরু, খাসি, মহিষ এমনকি উটের। তবে খাদ্যের প্রতি থাকতে হবে সচেতন। জনগণের মনে প্রশ্ন উঠছে কোরবানির গোস্ত খাওয়ার মাধ্যমে রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা আছে কি না। উত্তর হচ্ছে, কোরবানির গোস্ত কিংবা যে কোনো গোস্ত যদি ভালোভাবে সিদ্ধ করে রান্না করা হয়, তবে কোনো রোগজীবাণু ছড়ানোর সম্ভাবনা নেই। তবে রান্না করার আগে অবশ্যই হাত সাবানপানি দিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে নেবেন এবং রান্নায় ব্যবহৃত বাসনপত্র ডিটারজেন্ট দিয়ে ভালোভাবে পরিষ্কার করে নেওয়া ভালো।
পরিমাণমতো খাবেন: মূল সমস্যাটা নিঃসন্দেহে খাবারের পরিমাণে। অনেকেই একসঙ্গে প্রচুর পরিমাণ তৈলাক্ত বা চর্বিযুক্ত খাবার খেয়ে হজম করতে পারেন না। তা ছাড়া কোরবানির গোস্ত পরিমাণে একটু বেশিই খাওয়া হয়। ফলে পেট ফাঁপে, জ্বালাপোড়া করে, ব্যথা করে, বারবার পায়খানা হতে পারে। পর্যাপ্ত পানি পান না করার কারণে অনেকে কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগেন। যদিও কোনো নির্দিষ্ট খাবার খেতে মানা নেই, কিন্তু পরিমাণ বজায় রাখা খুবই জরুরি। ঈদের দিন তৈলাক্ত খাবার—পোলাও, বিরিয়ানি, মুরগি, খাসি বা গরুর গোস্ত, কাবাব, রেজালা ইত্যাদি খাওয়া হয়। এ ছাড়া আছে চটপটি, দইবড়া কিংবা বোরহানির মতো টক খাবারও। এসব খাদ্য সকাল আর দুপুরে কম খাওয়াই উত্তম। কারণ বিকেলে প্রচুর পরিমাণে গোস্ত খাওয়ার সম্ভাবনা থাকবেই।
সকালের খাবার : ঈদের নামাজ পড়তে যাওয়ার আগে অল্প করে সেমাই বা পায়েস খান। অনেকেই শরবত, কোমল পানীয়, ড্রিংকস, ফ্রুট জুস ইত্যাদি খাওয়া পছন্দ করেন। তবে মনে রাখা উচিত, বাজারে দেশি-বিদেশি ফ্রুট জুস যা পাওয়া যায়, সেগুলোর বেশির ভাগই আসল ফলের রস নয়। কৃত্রিম রং ও সুগন্ধি দিয়ে জুস নামের এসব পানীয় তৈরি করা হয়। চটকদার বিজ্ঞাপনের সুবাদে এগুলোই হয়ে যায় তাজা ফলের রস। আবার দীর্ঘদিন ধরে এসব জুস পান করলে শিশুদের তো বটেই, বড়দের পাকস্থলীরও মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। সেই সঙ্গে লিভার ও কিডনি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। বাজারের ফ্রুট জুস পান করলে কোনো উপকার তো হবেই না, বরং স্বাস্থ্য নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অতএব এসব না খেয়ে মৌসুমি ফল খাবেন, তাতে মজা ও উপকার দুই-ই পাবেন।
খাবার খাবেন বুঝে-শুনে : যাদের বয়স কম, শারীরিক বা হজমেরও কোনো সমস্যা নেই, তারা নিজের পছন্দমতো সবই খেতে পারেন, শুধু অতিরিক্ত না হলেই হলো, বিশেষ করে চর্বিজাতীয় খাদ্য। বেশি মাংস খেলে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা বেড়ে যায়। যাদের এনাল ফিশার ও পাইলস-জাতীয় রোগ আছে, তাদের পায়ুপথে জ্বালাপোড়া, ব্যথা ইত্যাদি বাড়তে পারে, এমনকি পায়ুপথে রক্তক্ষরণও হতে পারে। তাই প্রচুর পরিমাণে পানি, শরবত, ফলের রস, ইসবগুলের ভুসি ও অন্যান্য তরল খাবার বেশি খাবেন। পেটে গ্যাস হলে ডমপেরিডন, এন্টাসিড, ওমিপ্রাজল, প্যান্টোপ্রাজল-জাতীয় ওষুধ খেতে পারেন। যাদের আইবিএস আছে, তারা দুগ্ধজাত খাবার পরিহার করুন। দাওয়াতে গেলে পরিমিত খাবেন। অতিভোজন পরিহার করার চেষ্টা করবেন। হয়তো অনেক খাওয়াদাওয়া টেবিলে সাজানোই থাকবে, কিন্তু খেতে বসলেই যে সব খেতে হবে তা নয়। রাতের খাবার খেয়েই ঘুমিয়ে পড়বেন না। খাওয়ার অন্তত দুই ঘণ্টা পর বিছানায় যাবেন। খাবারের ফাঁকে ফাঁকে পানি খাবেন না, এতে হজমরস পাতলা হয়ে যায়।
চর্বি এড়িয়ে চলুন : অতিরিক্ত চর্বি খাওয়া এমনিতেই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। কোরবানির সময় বিষয়টি বিশেষভাবে খেয়াল রাখা উচিত। অনেক সময় দেখা যায়, আমরা রান্না সুস্বাদু হবে মনে করে গোস্তে বেশ কিছু চর্বি আলাদাভাবে যোগ করি, এমন ধারণা একেবারেই ভুল। গোস্তের সঙ্গে যথেষ্ট পরিমাণে সবজি খাওয়া যেতে পারে। পরিমিতি বোধ যেখানে রসনা সংবরণ করতে পারে, সেখানে ভয়ের কিছু নেই। গোস্তে তেল বা ঘিয়ের পরিমাণ কমিয়ে দিলে, ভুনা মাংসের বদলে শুকনো কাবাব করে খেলে, কোমল পানীয় ও মিষ্টি একেবারে কমিয়ে খেলে কোরবানির ঈদের সময়ও ভালোই থাকা যায়। সেই সঙ্গে হালকা ব্যায়াম বা বেশ কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে শরীর থেকে অতিরিক্ত ক্যালোরি কমিয়ে নিতে পারলে আরো ভালো।
বয়স্কদের থাকতে হবে সচেতন : মধ্যবয়সি ও বয়স্ক ব্যক্তিদের খাবার সম্পর্কে সচেতন থাকা আরো জরুরি। এমনকি উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, রক্তে অতিরিক্ত চর্বি ইত্যাদি না থাকা সত্ত্বেও এই বয়সের মানুষের ঈদের খাবারের ব্যাপারে বাড়তি সতর্ক থাকা দরকার। অতিভোজনে তাদের পেটভরা ভাব, অস্বস্তিকর অনুভূতি, বারবার ঢেকুর ওঠা এমনকি বুকে ব্যথা পর্যন্ত হতে পারে। বেশি গোস্ত খেলে তা পরিপূর্ণভাবে হজম হতে সময় লাগে। ডায়াবেটিক রোগীকে অবশ্যই মিষ্টিজাতীয় খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। তারা বরং টক খাবারের মাধ্যমে রসনা পূরণ করতে পারেন।
উচ্চরক্তচাপ, স্ট্রোক ও হৃদরোগীরা: অতিরিক্ত গরুর গোস্ত খেলে স্বাস্থ্যের ঝুঁকি বেড়ে যায়। শুধু গরু নয়, মহিষ, ছাগল ও খাসির গোস্তে থাকে উচ্চমাত্রার প্রোটিন ও ফ্যাট, তাই অতিরিক্ত গোস্ত খেলে স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ও কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যায়, বিশেষ করে যারা আগে থেকেই এসব রোগে ভুগছেন তাদের ঝুঁকি আরো বেশি। তাই গোস্ত খাওয়ার সময় অবশ্যই খেয়াল রেখে পরিমিত পরিমাণে এবং চর্বি ছাড়িয়ে খাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। সারা বছর তারা যে ধরনের নিয়মকানুন পালন করেন খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে, কোরবানির সময়ও সেভাবে চলাই ভালো।
কিডনির রোগীদের: যারা কিডনির সমস্যায় ভোগেন, যেমন ক্রনিক রেনাল ফেইলুর, তাদের প্রোটিন-জাতীয় খাদ্য কম খেতে বলা হয়। তাই গোস্ত খাওয়ার ব্যাপারে আরো সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কোনোক্রমেই অতিরিক্ত গোস্ত খাওয়া ঠিক হবে না। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সারা বছরের মতো ঈদের সময়ও একই খাবার খাওয়াই ভালো।
গোস্ত সংরক্ষণ: কোরবানির পরে গোস্ত ভালোভাবে সংরক্ষণ করা অত্যন্ত জরুরি। ফ্রিজে সংরক্ষণ সম্ভব হলে ভালো। তবে গ্রামগঞ্জে এমনকি শহরে অনেকের বাসায় ফ্রিজ না থাকলে সঠিকভাবে গোস্ত জ্বাল দিয়ে রাখতে হবে। এমনকি গোস্ত সেদ্ধ করে শুকিয়ে শুঁটকির মতো করে অনেক দিন খাওয়া যেতে পারে।
উপসংহার : ঈদ আনন্দের। আর খাবারের তৃপ্তি না থাকলে এই আনন্দ যেন পূর্ণতা পায় না। উৎসব-আনন্দ ও অতিভোজন একইভাবে চলবে। অন্তত একটা দিন হলেও সবার এমন ইচ্ছা থাকে। তার পরও সবাইকে রয়েসয়ে খেতে হবে। কারণ অসংযমীভাবে খাদ্য গ্রহণ করে শুধু শুধু এই করোনাকালে ডাক্তারের কাছে কিংবা হাসপাতালে ছোটাছুটির আদৌ প্রয়োজন আছে কি না, ভেবে দেখতে হবে। সবাইকে মনে রাখতে হবে, এবারের ঈদ অন্য সাধারণ ঈদের মতো নয়। ঈদ উদ্যাপনের পাশাপাশি স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যাপারটি সবাইকে নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। পশু কোরবানি, গোস্ত প্রস্তুতকরণের আগে ও পরে প্রত্যেকের হাত সাবানপানি দিয়ে ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে। বাড়ির শিশু, বৃদ্ধ এবং যারা অন্যান্য রোগে ভুগছেন তাদের দূরে রাখা ভালো।
পরিশেষে আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে, এবারের ঈদে হয়তো সবার মুখে সমান হাসি বইয়ে আনবে না। কারণ একদিকে করোনার হানা, অন্যদিকে নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও দুর্ঘটনা। অনেক মানুষের রুটি-রুজির নিশ্চয়তা নেই। অনেকেই আছেন যারা কবে তৃপ্তি করে দুমুঠো ভাত খেতে পেরেছেন বলতে পারেন না। এবারের কোরবানির ঈদটা না হয় তাদের কথা চিন্তা করেই হোক। মাসের পর মাস কোরবানির গোস্ত ফ্রিজে জমিয়ে না রেখে বিতরণ করুন সেই সব হতদরিদ্রের মাঝে। এতে তাদের যেমন পেট ভরবে, কিছু পুষ্টির চাহিদা মিটবে, তেমনি হবে মানবতার বিশাল কল্যাণ। আর এই আত্মত্যাগই তো কোরবানির আসল মাহাত্ম্য!
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ আব্দুল মুননাফ, মোবাইল : ০১৭১১ ৩৫৯৬৩১, ইমেইল: gsongbad440@gmail.com, IT Support: Trust Soft BD
Copyright © 2024 gramer songbad. All rights reserved.