ডেস্ক রিপোর্ট : আটক-গ্রেপ্তার এড়াতে কৌশল পরিবর্তন করেছে মাদক ব্যবসায়ীরা। আগে নির্ধারিত পয়েন্টে অবস্থান করে মাদক বিক্রি করলেও এখন কেনাবেচার বেশিরভাগই হচ্ছে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে। এতে মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তার করা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে খোদ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি)। বিশেষ করে ভয়ংকর মাদক আইস ও ইয়াবার বেশিরভাগই বিক্রি হচ্ছে অনলাইনে। কিছু অ্যাপস ব্যবহার করছেন মাদক কারবারিরা। সব মিলিয়ে মাদকের বাজার অনলাইনে ঢুকে পড়ায় মাদক ব্যবসায়ীদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তার এবং মাদকের বিস্তাররোধ করতে বেগ পেতে হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের।

কর্মকর্তারা বলছেন, কোথায় মাদক হস্তান্তর করা হবে তা মুঠোফোন বা হোয়াটসঅ্যাপ-ম্যাসেঞ্জারে কথা বলে আগে থেকেই ঠিক করে নেন ক্রেতা-বিক্রেতা। টাকাও আগেভাগেই চলে যায় বিকাশসহ মোবাইলব্যাকিং পদ্ধতিতে। ফলে বোঝার উপায় থাকে না যে- কে কোথায় কাকে মাদক সরবরাহ করছে। আগে নির্দিষ্ট পয়েন্টগুলোতে অভিযান চালালে মাদক বিক্রি বন্ধ করা সম্ভব হতো। কিন্তু এখন মাদক বিক্রির ধরন বদলে যাওয়ায় মাদক সরবরাহকারী বা বিক্রেতাকে চিহ্নিত করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এছাড়া, মূল মাদক ব্যবসায়ীরা সেলসম্যান বা সাবএজেন্ট নিয়োগ দিয়ে মাদক ব্যবসা পরিচালনা করছে। এতে ক্রেতারা ঘরে বসে অর্ডার দিলেই সুবিধাজনক স্থানে পৌঁছে যাচ্ছে মাদক। যা এখন সবচেয়ে ভয় ও উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিভিন্ন নামে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মাদক কারবারে জড়িত অন্তত অর্ধশত গ্রুপ রয়েছে। অনলাইনে মাদক বিক্রির ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পেতে প্রক্সি সার্ভার ব্যবহার করছেন কেউ কেউ। আবার কোনো কোনো গ্রুপ পরিচালনা করা হচ্ছে দেশের বাইরে থেকে। নানা নামে পরিচালনা করা হচ্ছে এসব গ্রুপ। কিছুদিন পরপর এসব গ্রুপের নাম পরিবর্তন করা হচ্ছে। কোনো কোনো গ্রুপে সাংকেতিক নামের পরিবর্তে ব্যবহার করা হচ্ছে কোড নম্বর।
আরও পড়ুন>> সুইস ব্যাংক থেকে টাকা সরিয়ে কোথায় রাখছেন বাংলাদেশিরা

গোয়েন্দা সূত্র বলছে, টেকনাফ থেকে ইয়াবা ও আইস এনে তা গোপন চ্যাটিংয়ের (যোগাযোগ) মাধ্যমে উচ্চবিত্তদের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আবদুল ওয়াহাব ভূঞা ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘অনলাইনে মাদক কেনাবেচারোধে আমরা কাজ করছি। মনিটরিং জোরদার করাসহ বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। শুধু অনলাইনই নয়, যে কোনো মাধ্যমে মাদক কেনাবেচা বন্ধে আমরা অভিযান জোরদার করেছি।

প্রতিবছরের মতো আজ ২৬ জুন পালিত হবে মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস। এ দিবস ঘিরে নানা পরিকল্পনার কথা বলা হলেও তা মাদক নির্মূলে দৃশ্যমান প্রভাব ফেলছে না। গত এক যুগে ব্যাপকভাবে ইয়াবার বিস্তার হয়েছে দেশে। এ অবস্থার মধ্যে নতুন আশঙ্কা তৈরি করেছে ইয়াবার চেয়ে অন্তত ২৫-৩০ গুণ বেশি শক্তিশালী মাদক আইস বা ক্রিস্টাল মেথ। ভারত-মিয়ানমার সীমান্তের তিনটি রুট দিয়ে অবাধে ঢুকছে এই মাদক। এক সময়ের ইয়াবা কারবারিরাই অধিক লাভের আশায় এখন আইসের ব্যবসা শুরু করেছে। চাহিদা বৃদ্ধিতে মিয়ানমার সীমান্তে গড়ে তোলা হয়েছে আইসের কারখানা।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে আইস এখন প্রধানত তিনটি রুট হয়ে আসছে। সেগুলো হলো-মিয়ানমার থেকে কক্সবাজারের টেকনাফ হয়ে বাংলাদেশ; মিয়ানমার-মিজোরাম-ত্রিপুরা-বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার-মনিপুর-ত্রিপুরা-ঢাকা। এর বাইরে আফ্রিকানদের মাধ্যমে আকাশপথে কিছু মাদক ঢুকছে।

২০১৮ সাল থেকে আলোচনা ওঠে অনলাইনে মাদকবিক্রির বিষয়। ওই বছরের ২৮ ডিসেম্বর সচিবালয়ে এক বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘এখন দেখছি অনলাইনে মাদক বিক্রি হচ্ছে। এ বিষয়ে কঠোর মনিটিরিং করা হবে।’

মাদকাসক্তের সংখ্যা কত

দেশে মাদকাসক্ত ব্যক্তির সংখ্যা জানতে ২০১৭ সালের জুলাই থেকে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট একটি সমীক্ষা করে। ওই সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, দেশে মাদকাসক্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৩৬ লাখ। তবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ধারণা, দেশে মাদকাসক্ত ব্যক্তির সংখ্যা ৭০ লাখের বেশি, যদিও অধিদপ্তর কখনো এ ধরনের কোনো সমীক্ষা করেনি। আর মাদক নিয়ে কাজ করা একাধিক সংগঠন বলছে, মাদকাসক্তের সংখ্যা এক কোটি ছাড়িয়েছে।

কী পরিমাণ মাদক ঢুকছে দেশে

বাংলাদেশে কোনো মাদক উৎপাদন হয় না। ইয়াবা-আইসসহ যেসব মাদক দেশে প্রচলিত রয়েছে, সেগুলো অন্য দেশ থেকে আসে। ইয়াবা ও আইস আসে মিয়ানমার থেকে।

জাতিসংঘের মাদক এবং অপরাধবিষয়ক সংস্থা (ইউএনওডিসি) বলেছে, বাজারে যত মাদক ঢোকে, তার মাত্র ১০ শতাংশ জব্দ করা হয়। তবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বলছে, জব্দ হয় ২০ শতাংশ। বাকি ৮০ শতাংশ অধরা থেকে যায়। ডিএনসির তথ্য বলছে, চলতি বছরের প্রথম ৪ মাসে দেশে ৬৬ কেজি আইস বা ক্রিস্টাল ম্যাথ জব্দ হয়েছে। এ পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে দেশে বিপুল পরিমাণে এই মাদক ঢুকছে। সরকারি এই সংস্থা বলছে, ২০১৯ সালের শুরুর দিকেও দেশে অপ্রচলিত মাদক ছিল আইস। তবে এখন ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভাগীয় ও জেলা শহরের মাদকসেবীরা আইসের প্রতি ঝুঁকছে। শুরুতে ‘পরীক্ষামূলকভাবে’ ইয়াবার চালানের সঙ্গে অল্প পরিমাণে আইস আসত। এখন আইস আনতে বিপুল টাকা খরচ করছেন ইয়াবার কারবারিরা। কারণ, ইয়াবার চেয়ে এই মাদক বিক্রি করলে কারবারিদের লাভ বেশি।

তবে মাদকের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর সর্বাত্মক অভিযানের পর সীমান্ত পথে ইয়াবা আসা কমেনি। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, অভিযান শুরুর বছরে (২০১৮ সালে) দেশে ৫ কোটি ৩০ লাখ ৪৮ হাজার ইয়াবা ট্যাবলেট জব্দ হয়। গত বছর জব্দ হয়েছে ৪ কোটি ৫৮ লাখ ৬৮ হাজার ৫৬৯টি ইয়াবা। আর চলতি বছরের প্রথম ৩ মাসে জব্দ হয়েছে ৮৮ লাখ ৫৭ হাজার ২৪২টি ইয়াবা ট্যাবলেট।

১৯ জেলার ৯৫টি পয়েন্ট দিয়ে আসছে মাদক

মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের সীমান্তবর্তী ১৯ জেলার ৯৫টি পয়েন্ট দিয়ে সবচেয়ে বেশি মাদক আসছে। দেশের এই ১৯ জেলা ভারত ও মিয়ানমারের সীমান্তে পড়েছে।

প্রতিবেদনে দক্ষিণাঞ্চলের জেলা কক্সবাজার ও বান্দরবান দিয়ে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা পাচারের ১৫টি রুট চিহ্নিত করা হয়েছে। পশ্চিমাঞ্চলের নওগাঁ জেলার সীমান্তবর্তী সাতটি নতুন রুট দিয়ে ফেনসিডিল আসছে। সাতক্ষীরার সাতটি পয়েন্ট দিয়ে আসছে ফেনসিডিল ও ইয়াবা। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট ও দিনাজপুরের ২৪টি পয়েন্ট দিয়ে ফেনসিডিলের পাশাপাশি হেরোইন আসছে। এ ছাড়া যশোর, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুরের ১৩টি পয়েন্ট দিয়ে দেশে ফেনসিডিল ঢুকছে।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, উত্তরাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলের ৮ জেলার ২৯টি পয়েন্ট দিয়ে ফেনসিডিল ও গাঁজা আসছে। এর মধ্যে পূর্বাঞ্চলের কুমিল্লার নয়টি পয়েন্ট এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছয়টি পয়েন্ট চিহ্নিত করা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, মাদকের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো ২০১৮ সালের ৪ মে ‘চল যাই যুদ্ধে, মাদকের বিরুদ্ধে’ স্লোগানে সর্বাত্মক অভিযান শুরু করে। অভিযান শুরুর এক বছরের মধ্যে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন ৩৫৮ জন মাদক ব্যবসায়ী। তাদের মধ্যে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ১৬৯ জন, র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ১০৬ এবং বিজিবির সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ১২ জন নিহত হন। বাকি ৭১ মাদক ব্যবসায়ী নিজেদের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তখন জানিয়েছিল। ওই অভিযানে শুধু কক্সবাজার জেলাতেই নিহত হন ৯৫ জন।
সুত্র : ঢাকা টাইমস।