আন্তর্জাতিক ডেস্ক : তুরস্কের একটি প্রত্যন্ত গ্রাম। সেখানে মানুষ সোজা হয়ে দাঁড়াতে বা হাঁটতে পারে না। তারা দুই হাত ও দুই পায়ে হামাগুড়ি দিয়ে চলাচল করে। তারা খুব দ্রুত হামাগুড়ি দেয়। তাতে স্বাভাবিক মানুষের চলার গতিতেই তারা চলাফেরা করে।
এই বিষয়ে সংবাদ সংগ্রহ করতে বেশ কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মী গ্রামটিতে আসে। তারা হামাগুড়ি দিয়ে চলাচল করা গ্রামের লোকদের ক্যামেরা বন্দি করে এবং তা প্রচার করে। এর মাধ্যমে গ্রামটি মানুষের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল।
গ্রামের মানুষের ওই দৃশ্যের ভিডিও দেখে প্রথমে অনেকেই বলেছিলেন, এটি স্থানীয়ভাবে পর্যটন বিকাশের জন্য পর্যটকদের আকৃষ্ট করার একটি কৌশল মাত্র। কিন্তু বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ ও গবেষক জানান, প্রতিটি নাগরিকের হাতে পুরু চামড়া ছিল। তা দেখে বোঝা যাচ্ছিল, বহু বছর ধরে তারা চলাচলের জন্য পায়ের সঙ্গে হাতও ব্যবহার করে আসছে। এ জন্য হাতে কোনো ধরনের সুরক্ষা নেয় না তারা।
মাটিতে প্রতিনিয়ত হামাগুড়ি দেওয়ার কারণে এখানে বসবাসকারী মানুষের শরীরের গঠন দুনিয়ার আর সব সাধারণ মানুষের মতো নয়। তাদের পিঠ ও কোমরের হাড়গুলো বেঁকে গেছে, নিতম্বগুলোও প্রশস্ত।
গবেষকরা আরো জানিয়েছেন, শরীরের আকৃতির পার্থক্য ছাড়াও এদের গড় আয়ুও কম। গ্রামটির সুস্বাস্থ্য ও শারীরিক শক্তিসম্পন্ন মানুষদের গড় আয়ু সাধারণ মানুষের তুলনায় প্রায় ১০ বছর কম।
চীনা সংবাদমাধ্যম সোহুর মতে, এই গ্রাম সম্পর্কে জানতে এসে অনেক বিশেষজ্ঞ এখানকার পানি থেকে শুরু করে সব ধরনের খাবারের ওপর গবেষণা করেছিলেন। কিন্তু এর ফলাফলে, তাদের প্রতিদিনের খাবার ও পানীয়তে আলাদা কিছু পাওয়া যায়নি।
কিছু বিশেষজ্ঞ গ্রামবাসীদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে দেখেন, গ্রামবাসীদের বক্তব্য এবং প্রতিক্রিয়া স্পষ্ট নয়। তারা খুব আস্তে কথা বলে। গ্রামের লোকেরা খুব কমই বাইরের বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তাদের বিয়ে মূলত ইনব্রিডিং (অন্তঃপ্রজনন) নির্ভর। মানে বহু প্রজন্ম ধরে একই ধরনের মানুষ বা প্রাণী থেকে বংশবৃদ্ধি। গ্রামের মানুষ একে অপরকে বিয়ে করে। ফলে এখানে প্রতিবন্ধী বাচ্চার জন্ম বেশি হয়। তাদের মস্তিষ্কের ধরন ও হাঁটার ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে।
কয়েকজন বিশেষজ্ঞ আরো জানিয়েছেন, কিছু স্থানীয় বাসিন্দা ‘সেরিবেলার অ্যাটাক্সিয়া’ (এক ধরনের মস্তিষ্কের রোগ, যা শরীরের ভারসাম্য নষ্ট করে) লক্ষ করা গেছে।
বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক দলের প্রধান ‘লিজা জে শাপিরো’ ওয়াশিংটন পোস্টে নিশ্চিত করেন, ‘সেরিবেলার অ্যাটাক্সিয়া’ রোগটি গ্রামবাসীদের ভারসাম্য বোধ জটিল করে তোলে। তা মানিয়ে নিতেই সেখানকার মানুষকে চারটি অঙ্গে ভর করে চলতে হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্টের মতে, অন্য একটি গবেষণায় দেখা গেছে, সিঁড়ি বেয়ে ওঠা ও নামার সময় হামাগুড়ি তাদের পছন্দে পরিণত হয়েছে। এভাবে তারা স্বাচ্ছন্দ্যে চলে, তাতে কোনো অস্বস্তি নেই বলে মনে হয়। এই চলাফেরা করার পদ্ধতি সাধারণ মানুষের সম্পূর্ণ বিপরীত।
সংবাদমাধ্যম সোহু আরো জানায়, গবেষকদের প্রশ্ন করা হয়েছে, কিছু শিশু সম্পূর্ণ সুস্থ জন্মগ্রহণ করে এবং সেরিবেলার অ্যাটাক্সিয়ায় আক্রান্ত না হয়েও কেন দুই হাত ও দুই পায়ে চলাফেরা করে? উত্তরে গবেষক দলটি জানিয়েছে, গ্রামটি একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত এবং পরিবহন ব্যবস্থা অনুন্নত-- তাই এটি বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন। ফলে সুস্থ শিশুরা স্বাভাবিকভাবে (দুই পায়ে) হাঁটা কখনো দেখেনি। তারা তাদের বাবা-মার কাছ থেকে শুধু দুই হাত এবং দুই পা দিয়ে নড়াচড়া শিখেছে। সময়ের সঙ্গে এভাবে পথচলা এখানকার মানুষের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
গবেষণা চলাকালে বিশেষজ্ঞরা গ্রামবাসীদের অন্তঃপ্রজননের পরিণতিগুলো জানানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তারা বিশেষজ্ঞদের মতামত উপেক্ষা করেন। শিশুরা স্বাভাবিক শরীরে জন্মালেও তাদের বাবা-মা কেবল হামাগুড়ি দিতে শেখায়। যার ফলে তাদের সারাজীবন হামাগুড়ি দিয়ে চলতে হয়।
গ্রামের এই বিষয়টি অনেকেই দুঃখজনক বলে মনে করে থাকেন। প্রখ্যাত প্রকৃতি বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনের ‘বিবর্তনবাদ’ তত্ত্ব অনুসারে, আধুনিক মানুষ আদিতে বন মানুষের মতো জীবন যাপন করত। হাজারো বছরের প্রচেষ্টায় তারা শরীরের কিছু অপ্রয়োজনীয় জিন সরিয়ে চার হাত-পায়ে দৌড়ানো থেকে দুই পায়ে হাঁটার জন্য পরিবর্তিত হয়েছিল।
তবে গ্রামের প্রবীণ প্রজন্ম শিশুদের বলে থাকে, দুই হাত দুই পায়ে চলাফেরা করাই হাঁটার সঠিক উপায়। ফলে ভবিষ্যতে শিশুরা শিক্ষিত হলেও এটির পরিবর্তন করা কঠিন হবে।
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ আব্দুল মুননাফ, মোবাইল : ০১৭১১ ৩৫৯৬৩১, ইমেইল: gsongbad440@gmail.com, IT Support: Trust Soft BD
Copyright © 2024 gramer songbad. All rights reserved.