বিশেষ প্রতিনিধি : রাজধানীর ধানমন্ডির বাসিন্দা নুরুন্নাহার বেগম (ছদ্মনাম)। পেশায় বেসরকারি একটি স্কুলের শিক্ষিকা। তার স্বামী একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। প্রতি মাসে বাসা ভাড়া দিয়ে দুই সন্তান নিয়ে মোটামুটিভাবে সংসার চলছিল। এর মধ্যে এক লাখ টাকা করে চার দফায় চার লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কিনেছেন তিনি। প্রথম দফায় কেনা এক লাখ টাকার সঞ্চয়পত্রের সময় হয়েছে চার বছরের কম। ইতোমধ্যে তিনি এই এক লাখ টাকা উঠিয়ে নেয়ার জন্য আবেদন করেছেন। যদিও এই সঞ্চয়পত্রের মেয়াদ ৫ বছর।
শুধু নুরুন্নাহার বেগম একা নন, তার মতো অনেকেই মেয়াদ শেষের আগেই টাকা তুলে নিচ্ছেন। তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, আমরা স্বামী-স্ত্রী মিলে মোটামুটিভাবে খেয়ে পরে কিছু সঞ্চয় করেছি। এখন দুজন মিলে যা ইনকাম করি তাতে বাসা ভাড়া দিয়ে, বাচ্চাদের পড়াশোনার খরচ দিয়ে, নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য কিনে, সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করে, পানি, বিদ্যুৎ আর কাজের বুয়ার বিল দিয়ে মাস শেষে অনেক টাকা ঘাটতি থাকে। আমার স্বামী মোটরসাইকেল ব্যবহার করে অফিস যাতায়াত করে। আমারও স্কুলে যেতে যাতায়াত ভাড়া লাগে। সব মিলিয়ে খরচ অনেক বেড়ে গেছে। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ঋণ করে চলতে হচ্ছে। তাই সঞ্চয়ের এক লাখ টাকা উঠিয়ে নেয়ার জন্য আবেদন করেছি। আয়ের সাথে টান পড়লে এখান থেকে খরচ করতে হবে। এছাড়া আর কোনো উপায় নেই। জীবন তো চালিয়ে নিতে হবে।
নিত্যপণ্য থেকে শুরু করে সব কিছুরই দাম বাড়ায় শুধু নুরুন্নাহার বেগম না মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর আয়-ব্যয়ের হিসাব মিলছে না। তাই সঞ্চয় ভাঙতে বাধ্য হচ্ছেন তারা।
বেসরকারি চাকরিজীবী আনিস আহমেদ (ছদ্মনাম) ব্যাংকে প্রতিমাসে ১০ হাজার টাকা জমা করতেন। পাঁচ বছর মেয়াদি এই ডিপোজিট সুবিধাটি তিনি করেছিলেন। চার বছরের বেশি সময় ধরে তিনি জমা করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু মেয়াদ শেষের আগেই এটি তুলে নিয়েছেন। আনিস আহমেদ ঢাকা টাইমসকে বলেন, যা বেতন পেতাম তা দিয়ে একটু হিসাব করে চলে প্রতি মাসে ব্যাংকে দশ হাজার টাকা জমাতাম। কিন্তু এখন খরচ বেড়ে যাওয়ায় জমাতে তো পারছি না, বরং ঋণ করা লাগে। তাই জমানো টাকা উঠিয়ে নিয়েছি।
জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি তলানিতে নেমেছে। আবার অনেকেই মেয়াদ শেষের আগেই টাকা তুলে নিচ্ছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়ায় মানুষের আয় কমেছে। তাই আমানত ও সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ নিম্নমুখী। এখন সরকারকে মানুষের আয় বাড়ানোর জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের পর থেকে বিশ্ববাজারেই বেড়েছে সব পণ্যের দাম। এ বছরের আগস্টে মূল্যস্ফীতি ছাড়ায় সাড়ে ৯ শতাংশ। যা গত ১১ বছর ৩ মাসের রেকর্ড ভেঙেছে। সেপ্টেম্বরেও মূল্যস্ফীতি ছাড়ায় ৯ শতাংশের ওপরে। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি মাত্র ৩৩০ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। যা গত অর্থবছরে ছিল ৮ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা।
এদিকে সেপ্টেম্বরে আসল পরিশোধের তুলনায় ৭০ কোটি টাকা বিক্রি কম ছিল। বর্তমানে ব্যাংক ও সঞ্চয় অধিদপ্তরে সঞ্চয়পত্র ভেঙে ফেলার আবেদন আসছে বহু বেশি। চলতি অর্থবছরের বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে নিট ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে সরকার। তবে বর্তমান যে পরিমাণ বিক্রি তাতে ঘাটতি হতে পারে বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা।
ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ায় সবচেয়ে বিপাকে পড়েছে মধ্যবিত্তরা। বিশেষ করে যারা চাকরি করেন নির্ধারিত বেতনে। তাদের তো অন্য কোনো আয় নেই। কিন্তু ব্যয় বেড়ে গেছে অনেক বেশি। তিনি আরও বলেন, সরকারি হিসেবেই মূল্যস্ফীতি এখন ৮ বা ৯ শতাংশের বেশি। কিন্তু আপনি যদি ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট রাখেন তাহলে পাবেন ৫ বা ৬ শতাংশ। তার মানে আপনার সঞ্চয় কমে যাচ্ছে। আপনার যে আয় তা দিয়ে ব্যয় মেটাতে পারছেন না।’
ক্যাবের সভাপতি বলেন, ‘কারো হয়তো সঞ্চয়পত্র কেনা ছিল। কারো ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট, কারো শেয়ার বাজারে কিছু বিনিয়োগ আছে। এখন খরচ মেটাতে না পারায় সঞ্চয় তুলে নিচ্ছেন অনেকে। আপনি দেখেন সরকার নিম্ন আয়ের ১ কোটি লোককে কম দামে চাল, ডাল, পেঁয়াজ বা তেলের মতো পণ্য দিচ্ছে। এখন মধ্যবিত্তরা টিসিবির লাইনেও দাঁড়াতে পারে না আবার এই এক কোটি লোকের মধ্যেও নেই। তারা ব্যয় মেটাতে গিয়ে পড়েছে বিপাকে।’
গোলাম রহমান সরকারকে মধ্যবিত্তদের আয় বাড়ানোর জন্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের আহবান জানিয়ে বলেন, ‘সরকারকে মধ্যবিত্তদের আয় বাড়াতে কিছু কর্মসূচি এবং পদক্ষেপ নিতে হবে। এছাড়া যারা কর্মহীন আছে তাদের কর্মসংস্থানের জন্য উদ্যোগ নিতে হবে।’
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ আব্দুল মুননাফ, মোবাইল : ০১৭১১ ৩৫৯৬৩১, ইমেইল: gsongbad440@gmail.com, IT Support: Trust Soft BD
Copyright © 2024 gramer songbad. All rights reserved.