রাজনীতি | তারিখঃ নভেম্বর ১২, ২০২২ | নিউজ টি পড়া হয়েছেঃ 23164 বার
নিজস্ব প্রতিবেদক : যুগপৎ আন্দোলনের রূপরেখা চূড়ান্ত করতে সরকারবিরোধী দলগুলোর সঙ্গে বিএনপির দ্বিতীয় দফা সংলাপ চলছে। দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় দফা সংলাপ শেষ করে বিএনপি একটি ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রীয় কাঠামো বা আন্দোলন নিয়ে একটি রূপরেখা ঘোষণা করতে যাচ্ছে। সব ঠিক থাকলে চলতি মাসে সংলাপ শেষ করে আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির সমাবেশে এই রূপরেখা ঘোষণা করা হতে পারে বলে আভাস পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, রূপরেখায় বিএনপি আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে ও পরে- এই দুই ধাপে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। দলের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে চূড়ান্ত অনুমোদনের পর দেশবাসীর সামনে এ রূপরেখা উপস্থাপন করবে বিএনপি। এরপর রূপরেখা অনুযায়ী আগামী বছরের প্রথমে শুরু হবে আন্দোলন। যা নির্বাচন পর্যন্ত পুরো এক বছর টেনে নেবে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো।
এদিকে যুগপৎ আন্দোলনে খালেদা জিয়াসহ সব রাজবন্দির মুক্তি, সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর, সংসদ বাতিল করে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের দাবি নিয়ে মাঠে নামার চিন্তা বিএনপি ও সমমনাদের থাকলেও এখন সরকার পতনের এক দফা দাবিকেই প্রাধান্য দেওয়ার সিদ্ধান্ত হচ্ছে বলে জানা গেছে।
প্রথম দফায় ২৩টি রাজনৈতিক দলের সাথে সংলাপ করে বিএনপি। গত ২৪ মে মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্যের সাথে বৈঠকের মধ্য দিয়ে প্রথম দফার সংলাপ শুরু হয়। যা ৩ আগস্ট গণঅধিকার পরিষদের সঙ্গে বৈঠকের মাধ্যমে শেষ হয়। এরপর প্রথম দফার সংলাপ থেকে উঠে আসা পরিকল্পিত যুগপৎ আন্দোলনের দাবিগুলো চূড়ান্ত করতে গত ২ অক্টোবর দ্বিতীয় দফা সংলাপ শুরু করে বিএনপি। যা এখনও চলছে।
এদিকে প্রথম দফা সংলাপে একমত হওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে উত্থাপিত বিভিন্ন দাবির বিষয়ে সমঝোতায় পৌঁছানো এবং আন্দোলনের দাবিগুলো সুনির্দিষ্ট করে সরকার পতন আন্দোলনের দিনক্ষণ ঠিক করে নেওয়া হচ্ছে এই দ্বিতীয় দফার সংলাপ থেকে। এই সংলাপের শেষে একটি লিয়াজোঁ কমিটি গঠন করা হতে পারে। যারা দ্বিতীয় দফা সংলাপে গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ সকল দলের সাথে সমন্বয় করে কিছুটা কাটছাঁট করবেন। কাটছাঁটের পর যে রূপরেখা দাঁড়াবে তা নিয়ে পরবর্তীতে দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে তৃতীয় দফা সংলাপের পরিকল্পনা রয়েছে বিএনপির। তবে তার প্রয়োজন নাও পড়তে পারে বলে মনে করছেন দলটির একাধিক নেতা।
দ্বিতীয় দফা সংলাপের বিষয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘প্রথম দফা সংলাপে আমরা নীতিগতভাবে একমত হয়েছিলাম যে, একটা যুগপৎ আন্দোলনে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলব। দ্বিতীয় দফা সংলাপে আমরা কোন কোন দাবিতে বা কোন কোন ইস্যুতে আন্দোলনটা করব, সেই বিষয়ে আলোচনা করে ঐক্যমতে এসেছি।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির দুজন সদস্য এবং বিএনপির সংলাপে অংশ নেওয়া কয়েকটি দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এদিকে কবে থেকে এই যুগপৎ আন্দোলন শুরু হবে, এর রূপরেখা কবে ঘোষণা করা হবে- কৌশলগত কারণে সেই দিনক্ষণ এখনই প্রকাশ করতে চাচ্ছে না বিএনপি। সংলাপে অংশ নেওয়া দলগুলোর নেতাদেরও এই দিনক্ষণ প্রকাশ না করতে বলা হয়েছে দলটির পক্ষ থেকে। তবে যুগপৎ আন্দোলনের রূপরেখা চূড়ান্ত পর্যায়ে। আগামী ১০ ডিসেম্বরে ঢাকার সমাবেশে ঘোষণা করা হতে পারে এই চূড়ান্ত রূপরেখা। এ বিষয়ে একমত পোষণ করা রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতারা ওই সমাবেশ মঞ্চে উপস্থিত হয়ে একযোগে এই রূপরেখা ঘোষণা করবেন বলে আভাস পাওয়া গেছে। তবে বিষয়টি এখনও আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে।
ওই দিনের সমাবেশ থেকে নির্বাচন পরবর্তী তারেক রহমানের নেতৃত্বাধীন জাতীয় সরকার বিষয়ক একটি ধারণাও প্রকাশ করা হতে পারে। একই সঙ্গে সংবিধান ও বিচার বিভাগের বেশ কিছু বিষয় পরিবর্তন, দুর্নীতি ও গুমে জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করাসহ বিএনপি ক্ষমতায় গেলে কীভাবে দেশ পরিচালনা করা হবে, সে বিষয়ে বেশ কিছু প্রতিশ্রুতিও তুলে ধরা হতে পারে ওই সমাবেশে। এছাড়া বেগম খালেদা জিয়াকে ওই দিনের সমাবেশে উপস্থিত করে চমক দেখানোর প্রস্তাব বিএনপির একাধিক নেতার পক্ষ থেকে উপস্থাপন করা হলেও বিষয়টি এখনও অনিশ্চিত বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
এদিকে চলমান দ্বিতীয় দফার সংলাপে কী রূপরেখা চূড়ান্ত হওয়ার পথে, সে বিষয়ে গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবে এক আলোচনা সভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী তার বক্তব্যে কিছুটা ইঙ্গিত দিয়েছেন। বিএনপির এই নেতা বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থেকে সরে গেলে পরবর্তী সময়ে কী হবে, তা নিয়ে অনেকে চিন্তিত। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ নিয়ে বিএনপির পরিকল্পনা কী, তাও অনেকে জানতে চান। বিএনপির পরিকল্পনা তারেক রহমান পরিষ্কার করেছেন। এখানে কিছু গোপন রাখা হয়নি। যারা বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে থাকবে, তাদের নিয়ে তারেক রহমানের নেতৃত্বে একটি জাতীয় সরকার গঠন হবে। এই জাতীয় সরকার কী ভূমিকা পালন করবে, তা পরিষ্কার করা হবে। সংবিধানে কী কী পরিবর্তন আনতে হবে, বিচার বিভাগে কী পরিবর্তন করা হবে, তা বলা হবে। যারা এখন গুম-দুর্নীতিতে অংশ নিচ্ছে, তাদের বিচার হবে। যারা মিথ্যা মামলা দিয়ে খালেদা জিয়াকে জেল খাটিয়েছেন, তাদের বিচার হবে। আগুন-সন্ত্রাসের আড়ালে কারা ছিল, তাদের খুঁজে বিচার করা হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ডান, বাম ও মধ্যপন্থী ৩০ থেকে ৩৫টি দলকে এক সুতোয় গেঁথে সরকার পতন আন্দোলন মাঠে গড়াতে চায় বিএনপি। ইতোমধ্যেই প্রথম দফায় ২৩টি রাজনৈতিক দলের সাথে সংলাপ হয়েছে। ওই দলগুলোর সাথেই দ্বিতীয় দফা সংলাপ চলছে। আর এই যুগপৎ আন্দোলনে কার্যকর পরিবেশ সৃষ্টির জন্য দীর্ঘদিন ধরেই দৌড়ঝাঁপ করছেন বিএনপির সিনিয়র নেতারা। প্রথম দফায় ২৩টি দলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সংলাপ করলেও বিভিন্ন কারণে আরও কিছু দলের সঙ্গে সংলাপ করতে পারেনি। তবে আরও ১৩টি দলের সাথে অনানুষ্ঠানিকভাবে সংলাপ হয়েছে বলে জানা গেছে। আর এবার দ্বিতীয় দফায় আগের ২৩টি দলসহ আরও ৬ থেকে ৭টি দলের সঙ্গে সংলাপ করতে চায় বিএনপি। ২০০১ সালের আগে চারদলীয় জোট করে যেভাবে রাজপথ দখলে রেখে ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয় লাভ করে সেভাবে আন্দোলন করতে মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা। তবে সেবার জোটগতভাবে আন্দোলন হলেও এবার হবে যুগপৎ আন্দোলন। এমন কথাই জানাচ্ছেন বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা। বিভিন্ন সভা-সমাবেশে দেওয়া বক্তব্যে তারা এমন ইঙ্গিতই দিচ্ছেন।
বিএনপির নীতি নির্ধারক পর্যায়ের একজন নেতা জানান, পরিস্থিতি বুঝে শুধু বিএনপির সংসদ সদস্যরা নন, আরও কয়েকটি দলের সংসদ-সদস্যরা পদত্যাগ করতে পারেন। কিন্তু তা এখনই নয়। কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, এখনই পদত্যাগ করলে নির্বাচন কমিশন উপনির্বাচনের সুযোগ পাবে। এমন সময় পদত্যাগ করা হবে, যখন উপনির্বাচন করারও সময় থাকবে না। এতে করে সরকার আরও বেশি বেকায়দায় পড়বে।
বিএনপির সঙ্গে সংলাপে ‘যুগপৎ’ আন্দোলনে রাজি দলগুলো হচ্ছে- লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, নাগরিক ঐক্য, গণঅধিকার পরিষদ, গণসংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, মুসলিম লীগ, জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর), জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা), ন্যাশনাল পার্টি (ন্যাপ-ভাসানী), জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি, সাম্যবাদী দল, ডেমোক্রেটিক লীগ, ইসলামী ঐক্যজোট, ইসলামিক পার্টি, এনডিপি, পিপলস লীগ, বাংলাদেশ জাতীয় দল, মাইনরিটি জনতা পার্টি ও গণফোরাম (মন্টু)।