সুপার সাইক্লোন আম্পানের আঘাতে যশোরে ২৮৩ কোটি টাকার ক্ষতি
নিজস্ব প্রতিবেদক : সুপার সাইক্লোন ঘূর্ণিঝড় আম্পানে জেলার বিভিন্ন এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত বহু মানুষ এখনো স্বাভাবিক ছন্দে ফিরতে পারেননি। ঘরবাড়ি ভেঙে যাওয়ায় আশ্রয়হীন কয়েক হাজার মানুষ। বিদ্যুৎহীন বহু এলাকা।
সুপার সাইক্লোন আম্পানের আঘাতে যশোরেই সবচেয়ে বেশি ১৩ জনের প্রাণহানি হয়েছে। আর ক্ষতিগ্রস্ত সাড়ে পাঁচ লাখ পরিবার। ঘরবাড়ি, ফসল, গাছপালা, কাঁচা পাকা রাস্তা ও বিদ্যুতের খুঁটির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন বলেন, আম্পানের আঘাতে যশোর জেলায় ২৮৩ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। বিপুল ক্ষতির বোঝা সামলে মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোই বড় চ্যালেঞ্জ।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিসমতে, ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মণিরামপুর, শার্শা, অভয়নগর, কেশবপুর ও চৌগাছায় উপজেলায়। জেলায় মোট ক্ষতির পরিমাণ ২৮৩ কোটি ৩০ লাখ ৮০ হাজার টাকা। গাছ উপড়ে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত আরও অর্ধশতাধিক মানুষ। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫ লাখ ৭৮ হাজার ২১৭ জন মানুষ। ১৫ হাজার ২৩৪ হেক্টর জমির ফসলহানি ও ৬৪ হেক্টর বীজতলা নষ্ট, ৩৩ কিলোমিটার পাকা ও কাঁচা রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এক লাখ ৬৭ হাজার ৫০০ ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কৃষি সেক্টরে ১৩২ কোটি ১২ লাখ ৫৩ হাজার টাকা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ১৩২ হেক্টর মাছের পুকুর ও খামারে দুই কোটি ৯৭ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
জেলায় বিদ্যুৎ লাইনের সম্পূর্ণ ক্ষতি ১৪ দশমিক ৫ কিলোমিটার ও আংশিক ১৫৬ কিলোমিটার বিদ্যুতের লাইন। ক্ষতির পরিমাণ ২১ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। জেলার ৩৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৯ লাখ ৭০ হাজার টাকার ক্ষতি, ১৫৯টি উচ্চ বিদ্যালয়ে ১৩ কোটি ৩১ লাখ টাকা ও ৭৬টি মাদ্রাসায় ৭৭ লাখ ৮০ হাজার টাকা। জেলার ৫৫০টি গভীর নলকূপের তিন কোটি ৭১ লাখ টাকা। জেলায় অগভীর নলকূপ এক হাজার ২২০টি। যার ক্ষতির পরিমাণ ৯৮ লাখ টাকা। হস্তচালিত নলকূপ ২৫টির ৬ লাখ টাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিভিন্ন বেসরকারি মোবাইল অপারেটরের ১৫টি মোবাইল টাওয়ারে ১৩ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। ৩৮৪টি মসজিদে এক কোটি ১০ লাখ টাকা ও ৯৬৬টি মন্দিরে ১৯ লাখ ৪২ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে।
৩০টি গীর্জায় ৮৫ হাজার ক্ষতি হয়েছে। যশোর জেলায় ৪০ কিলোমিটার রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতির পরিমাণ ৮ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। এছাড়া ১১টি ব্রিজ কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যা ক্ষতির পরিমাণ ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা। ৬ হাজার ৭৯৭টি পশু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যা মোট এক কোটি ৬৪ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন পাবলিক টয়লেট, বিভিন্ন পানির উৎস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১১ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। একটি ক্লিনিক ও আটটি কমিউনিটি ক্লিনিকে ক্ষতি হয়েছে ৪ লাখ ৬০ হাজার টাকা।
যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার বারাকপুর গ্রামের কৃষক আবদুল আজিজ জানান, প্রায় ৩০ বছর ধরে কৃষি কাজে সম্পৃক্ত। আম্পানের আঘাতে ল-ভ- হয়েছে তার জীবিকা। দুই বিঘা পেঁপে, এক বিঘা করলা (উচ্ছে), ২৫ কাঠা জমির তিল ও দুই বিঘা জমির পাট ক্ষতিগ্রস্ত।
যশোর সদর উপজেলার পাঁচবাড়িয়া গ্রামের কৃষক হারুন অর রশিদ বলেন, সাড়ে তিন বিঘা জমির লিচুর সব ধূলিসাৎ করে দিয়েছে ঝড়ে। সঙ্গে লাউ, উচ্ছের মাচাও উলোটপালট করেছে।
চৌগাছার তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা হারুন কবীর রুবেল বলেন, ১২ বিঘা জমি বর্গা নিয়ে কলা পেঁপে ও পেয়ারা চাষ করেছিলাম। ঘূর্ণিঝড়ে কলা ও পেঁপের ক্ষেত সব নষ্ট হয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক ড. আখতারুজ্জামান বলেন, প্রাথমিক প্রতিবেদনে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র পাওয়া গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের তালিকা তৈরির কাজ চলছে।
মৎস্য অধিদফতর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আনিছুর রহমান জানান, যশোর জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত হ্যাচারি ও চাষিদের তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। সরকারি সহায়তা পেলে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সাহায্য করা হবে।
যশোর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির-২ জেনারেল ম্যানেজার অরুণ কুমার কু- বলেন, আম্পানে বিদ্যুৎ বিভাগের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ৩০২টি বৈদ্যুতিক পিলার ভেঙে যায়। তার ছিড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। দিন রাত কর্মীরা ছুটে চলছেন বিদ্যুৎ লাইন মেরামতের কাজে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা সানোয়ার হোসেন জানান, আম্পানের আঘাতে যশোরের ৮টি উপজেলার ৯৩টি ইউনিয়ন এলাকায় কম বেশি ক্ষতি হয়েছে। আট উপজেলায় টিন বিতরণ চলছে। ১০০ মেট্রিক টন চালও বিতরণ হচ্ছে।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আরিফ জানান, জেলায় ৫ লক্ষ ৭৮ হাজার ২১৭ জন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইতোমধ্যে ১৩শ’ বান টিন বিতরণ করা হয়েছে। প্রতি বান টিনের সঙ্গে ৩ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ঝড়ে যারা প্রাণ হারিয়েছে তাদের প্রত্যেক পরিবারের মাঝে ২০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে।