নড়াইলে এতিমদের আলোর পথ দেখায় ওরা
নড়াইল প্রতিনিধি : মা-বাবা হারা এতিম শিশুদের মানুষের মত মানুষ হিসাবে গড়ে তুললে কাজ করছে নড়াইল সদর উপজেলার ‘সীমানন্দপুর গরীবশাহ এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্র্ডিং’ এবং ‘আজিজুর রহমান ভূইয়া বালিকা এতিমখানা। এতিম শিশুদের নিয়ে ৩৮ বছর যাবৎ কাজ করছে প্রতিষ্ঠান দুইটি। বর্তমানের জেলার মডেল এতিমখানা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
নড়াইল জেলার বিভিন্ন এলাকা, যশোর, সাতক্ষীরা, চুয়াডাঙ্গা, বরিশাল, ফরিদপুরসহ কয়েক জেলার এতিমদের আশ্রয়স্থল এই দু’টি প্রতিষ্ঠান। ৬-১৮ বছরের এতিম শিশুদের লেখাপড়া, থাকা-খাওয়া, ভরনপোষন, চিকিৎসাসহ সকল দায়িত্ব পালন করে মানুষের মত মানুষ হিসেবে তৈরী করা হচ্ছে এখানে থাকা এতিমদের।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানাগেছে, নড়াইল সদর উপজেলার চন্ডিবরপুর ইউনিয়নের সীমানন্দপুর গ্রামে অবস্থিত ‘সীমানন্দপুর গরীবশাহ এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্র্ডিং’ ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত। ১৯৮৪-৮৫ অর্থবছরে এতিমখানাটি সমাজসেবার মাধ্যমে সরকারি অনুদান প্রাপ্ত হয়।
সরেজমিনে দেখা গেছে এই এতিমখানাতে ৬ থেকে ১৮ বছরের এতিম শিশু রয়েছে প্রায় আড়াই শতাধিক। চন্ডিবরপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান ভূইয়া ‘আজিজুর রহমান ভূইয়া বালিকা সমাজসেবা এতিমখানার’ সভাপতি। এই চেয়ারম্যানের নামেই ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘আজিজুর রহমান ভূইয়া বালিকা সমাজসেবা এতিমখানা। এখানে প্রায় ৩শ’ মেয়ে এতিম শিশুর আশ্রয় হয়েছে। একই গ্রামে পাশাপাশি অবস্থিত এ দু’টি এমিতখানায় মোট ছেলে-মেয়ে রয়েছে ৫শতাধিক। আশেপাশের ৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করছে অল্প বয়সে বাবা-মা হারানো এই সব এতিম শিশুরা। নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার নলদী এলাকার চার বছর বয়সের শিশু নাইমা ও আট বছর বয়সের শিশু সুলতানা আপন দুই বোন। বাবা-মাকে হারিয়ে এখন আশ্রয় পেয়েছে এই এতিমখানাতে। কথা হলে তারা জানায়, এখানে তাদের তিন বেলা পেট ভরে খেতে দেওয়া হয়, লেখাপড়াসহ যাবতীয় সকল খরচ বহন করে এই প্রতিষ্ঠান থেকে। এখানে আশ্রয় পেয়ে অনেক খুশি অল্প বয়সে বাবা-মা হারানো নাইমা ও সুলতানার মত শিশুরা।
কমলমতী এই শিশুদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ‘আজিজুর রহমান ভূইয়া বালিকা সমাজসেবা এতিমখানা’ মেয়েদের এই এতিমখানাতেই সেলাই, মাছ চাষ, ছাগলপালনসহ প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদেরকে স্বাবলম্বী করার চেষ্টা চলছে। এই এতিমখানা থেকেই দর্জি কাজের প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রতিষ্ঠানের মধ্যেই দর্জি কাজ করছে মুক্তা খানম, রুমা খানম ও রুপা খানমসহ অনেকে।
তারা জানায়, এখন তারা নিজেরাই নিজেদের জামাকাপড় বানিয়ে পরেন এবং প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য মেয়েদের পোষাক তৈরী করে দেন তার মত কয়েকজন সহপাঠিরা।
সীমানন্দপুর গরীবশাহ এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্র্ডিং এবং ‘আজিজুর রহমান ভূইয়া বালিকা সমাজসেবা এতিমখানার ছেলে-মেয়েদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, দু’টি এতিমখানাতেই তাদের থাকা, খাওয়া, চিকিৎসা, ভরনপোষন এবং লেখাপড়ার সকল খরচ এতিমখানা থেকেই বহন করা হয়। এখানে ভর্তি হতে তাদের কোন টাকা লাগেনা। ৬বছর থেকে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত প্রতিটা শিশুর সমস্ত খরচ প্রতিষ্ঠান থেকেই বহন করা হয়।
জানা গেছে, ‘আজিজুর রহমান ভূইয়া বালিকা সমাজসেবা এতিমখানা’ থেকে প্রতিষ্ঠানের খরচে লেখাপড়া শিখিয়ে অন্তত ৫শ’ মেয়েকে বিবাহ দিয়েছে। এদিকে সীমানন্দপুর গরীবশাহ এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্র্ডিং এতিমখানা থেকে বিনা খরচে লেখাপড়া শেষ করে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করছে অন্তত হাজারখানেক ছেলে, যার মধ্যে কমপক্ষে ২’শ ছেলে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে চাকুরী করছে।
নড়াইল জজ কোর্টে বর্তমানে কর্মরত আছেন মো: জাকির হোসেন। তার সাথে কথা হলে সে জানায়, ছোট বেলা বাবা-মাকে হারিয়ে সীমানন্দপুর গরীবশাহ এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্র্ডিংয়ে আশ্রয় পেয়ে লেখাপড়া করতে পেরেছি বলেই আল্লাহর রহমাতে আজ আমি একটি সরকারি চাকুরী পেয়েছি। শিশুকাল থেকে শুরু করে এতিম কোটায় চাকুরী পাওয়ার পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত বিনা খরচে এতিমখানায় থেকেছে বলেও জানান তিনি।
‘আজিজুর রহমান ভূইয়া বালিকা সমাজসেবা এতিমখানা’ থেকে শিউলি খানম লেখাপড়া শেষ করে বর্তমানে কালিয়া উপজেলা সাস্থ্য কমপ্লেক্স সেবিকা হিসাবে কর্মরত আছে। শিউলি খানমের মত শতাধিক এতিম বিভিন্ন প্রতিষ্টানে চাকুরী করছে।
ভূইয়া আজিজুর রহমান বালিকা এতিমখানার সুপার কাজী আব্দুল কাদের বলেন, আমাদের এতিম খানায় প্রকৃত এতিমরাই থাকেন। সরকারিভাবে যে বরাদ্দ দেওয়া হয় প্রয়োজনের তুলনায় তা খুবই সামান্য। সমাজের বৃত্তবানদের এসকল এতিমখানার এতিমদের সহযোগিতার আহ্বান জানান তিনি।
সীমানন্দপুর গরীবশাহ এতিমখানার সুপার কাজী রাকিবুল ইসলাম বলেন, আমাদের এতিমখানার ছেলেরা সিমান্দপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসা, বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ মহাবিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করছে। প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তাদের সমস্থ খরচ বহন করা হয়।
চন্ডিবরপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান ভূইয়া বলেন, নড়াইল সদর উপজেলার ‘সীমানন্দপুর গরীবশাহ এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্র্ডিং’ এবং ‘আজিজুর রহমান ভূইয়া বালিকা এতিমখানা’ দু’টি অনেক আগেই জেলার মডেল এতিমখানা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। এখানে থাকা সকল এতিমই খুবই অসহায়। বাবা-মা হারানো এসকল এতিমদের সমস্থ খরচ প্রতিষ্ঠান থেকেই বহন করা হয়। সরকার থেকে যে বরাদ্দ পায় তা দিয়ে এতিমদের খরচ চালানো খুবই কঠিন। সরকারের কাছে জেলার সকল এতিমখানার এতিমদের জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধির দাবী করেন তিনি।
জেলা সমাজ সেবা দফতরের উপ-পরিচালক রতন কুমার হালদার বলেন, সমাজসেবার তত্ত্বাবধানে ৩টি উপজেলায় মোট এতিমখানার সংখ্যা ৪৩টি। ক্যাপিটেশন গ্রান্ড পাবার শর্ত অনুযায়ী প্রত্যেকটি এতিমখানা নিজস্ব অর্থে যে কয়েকজন এতিম পালন করেন তার দ্বিগুন এতিম থাকলেই কেবল অর্ধেকের জন্য অনুদান পান। সকল এতিমখানায় তালিকাভূক্ত অনুযায়ী এতিম আছে। এতিমখানাগুলি বিধি মোতাবেক পরিচালিত হচ্ছে। আমার জানা মতে কোন অনিয়ম হচ্ছেনা। বিশেষ করে নড়াইল সদরের ‘সীমানন্দপুর গরীবশাহ এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্র্ডিং’ এবং ‘আজিজুর রহমান ভূইয়া বালিকা এতিমখানা’ দু’টি জেলার মডেল এতিমখানা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। বছরের পর বছর এই এতিমখানা দু’টি অসহায় এতিম শিশুদের মানুষ গড়ার কাজ করে যাচ্ছে।