জীবন-জীবিকা উন্নয়ন রক্ষার বাজেট আজ : বাজেটের আকার ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা
করোনাভাইরাসের মহামারীর মধ্যে বিপর্যস্ত হয়ে গেছে উৎপাদন, বিপণন, যোগাযোগ, আমদানি-রপ্তানি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। থেমে গেছে মানুষের জীবন, জীবিকা ও উন্নয়ন। এ অবস্থায় ২০২০-২১ বছরের আয়-ব্যয়ের হিসাব সাজানো হয়েছে জীবন ও জীবিকাকে রক্ষা এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যেসব উন্নয়ন কর্মকা- শুরু করা হয়েছে সেগুলো ধরে রাখার অভীষ্ট স্থির করে। আজ বিকাল ৩টায় জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এ বাজেট উপস্থাপন করবেন।
২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটের সম্ভাব্য আকার ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রস্তাবিত বাজেটের অর্থ জোগানোর ক্ষেত্রে রাজস্ব বাবদ আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লাখ ৮২ হাজার ১৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) আয় করতে হবে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। বাজেটের ব্যয় মেটাতে করবহির্ভূত রাজস্ব আহরণ করতে হবে ১৫ হাজার কোটি টাকা এবং কর ছাড়া অন্যখাত থেকে আয়ের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে ৩৩ হাজার ৩ কোটি টাকা। এর বাইরে বৈদেশিক অনুদান পাওয়ার পরিমাণ ধরা হয়েছে ৪ হাজার ১৩ কোটি টাকা।
এছাড়া এর বাইরেও ২০২০-২১ সরকার অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছে ১ লাখ ৯ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। যার মধ্যে ব্যাংকিং খাত থেকে ৮৪ হাজার ৯৮০ কোটি, সঞ্চয়পত্র থেকে ২০ হাজার কোটি ও অন্যান্য খাত থেকে ঋণ নেবে আরও ৫ হাজার কোটি টাকা। আগামী বছরে বৈদেশিক ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছে ৭৬ হাজার ৪ কোটি টাকা।
এবারই সরকারকে একটি চরম অবস্থা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। ১৯৭১ সালের পর দেশে এমন পরিস্থিতি আর মোকাবিলা করতে হয়নি। এ অনিশ্চয়তার শেষ কবে তাও বলা যাচ্ছে না। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার টানা তিনবারের শাসন আমলে পর পর ১১টি বাজেট উপস্থাপন করেছে এ জন্য কিছুটা সহজ হলেও তা মসৃণ হচ্ছে না। বহুমুখী সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এ জন্য সতর্কতা অবলম্বন করতে হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সরকারের সিনিয়র মন্ত্রীরাও একই কথা বলছেন।
এবারের বাজেটে আয়-ব্যয় ও প্রবৃদ্ধি ইত্যাদিকে ছাপিয়ে গেছে করোনাভাইরাস থেকে কীভাবে জীবন রক্ষা করা যায় তার পথনকশা এবং তার অভিঘাতে উদ্ভূত পরিস্থিতিকে মোকাবিলার পরিকল্পনা। ভয়ংকর কোভিড-১৯ এর কারণে তিন কোটির অধিক মানুষ পুরোপুরি বা আংশিকভাবে কাজ হারিয়েছে। এসব মানুষের কাজ দেওয়া ও মুখে দুবেলা খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। সরকার ইতোমধ্যে এ কাজটি শুরু করেছে। প্রধান কাজটি করতে হবে ২০২০-২১ অর্থবছরে।
এ বাজেট নিয়ে অর্থমন্ত্রীও সে পরিকল্পনার কথা বলেছেন। বাজেট উপস্থাপনের আগে গতকাল তিনি বলেছেন, বাজেটে মানুষের জন্য কাজ এবং খাবার দেওয়ার দিকনির্দেশনা থাকছে, ব্যবস্থা রাখতে হচ্ছে। দেশের মানুষকে কাজ দিতে হবে। তাদের মুখে খাবার তুলে দিতে হবে। বর্তমান সময়ে সরকারের এটিই প্রধান কাজ। সে লক্ষ্য নিয়ে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীও বড় হচ্ছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি সাজানো হয়েছে করোনাভাইরাসে অভিঘাত মোকাবিলার উপযোগী করে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বা এডিপির আকার ধরা হয়েছে দুই লাখ পাঁচ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে এক লাখ ৩৪ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকা ও বৈদেশিক সহায়তা বাবদ ৭০ হাজার ৫০১ কোটি ৭২ লাখ টাকা খরচ করা হবে।
করোনাভাইরাসের কারণে সামগ্রিক অর্থনীতির সঙ্গে নতুন এডিপিতেও প্রভাব পড়েছে। এ কারণে বৈদেশিক সহায়তায় বরাদ্দ কমানো হয়েছে। একই সঙ্গে প্রকল্পের সংখ্যাও কমিয়ে করোনাভাইরাসের ক্ষত মেরামত করে ঘুরে দাঁড়ানোর উপযোগী করে সাজানো হয়েছে। এবারের এডিপিতে স্বাস্থ্য ও কৃষি খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছে সরকার। গুরুত্বের দিক থেকে এর পরেই সর্বোচ্চ বরাদ্দ থাকছে পরিবহন খাতে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ ও তৃতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ পাচ্ছে শিক্ষা খাত।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, করোনা সংক্রমণ এবং এর প্রভাব ঠেকাতে আগামী অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে ১৩ হাজার ৩৩ কোটি টাকা। নতুন এডিপিতে কৃষি খাত পাচ্ছে ৮ হাজার ৪২৪ কোটি টাকা। পরিববহন খাতে বরাদ্দ ধরা হয়েছে প্রায় ৫২ হাজার কোটি টাকা। বিদ্যুৎ খাতে বরাদ্দ ধরা হয়েছে ২৫ হাজার কোটি টাকা। শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে সাড়ে ২৩ হাজার কোটি টাকা।
আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের এডিপিতে বরাদ্দসহ অনুমোদিত প্রকল্প যুক্ত হচ্ছে এক হাজার ৫৮৮টি (স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের ছাড়া)। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপিতে এর পরিমাণ ছিল এক হাজার ৭৪৪টি। ফলে নতুন অর্থবছরে কমছে ১৫৬টি উন্নয়ন প্রকল্প। সামর্থ্য ও প্রয়োজনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জীবন ও জীবিকা রক্ষা এবং আগের গৃহীত উন্নয়ন কার্যক্রমগুলো অব্যাহত রাখতে যে কার্যক্রম না নিলেই নয় সেগুলো গ্রহণ করা হচ্ছে। পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পসহ এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পকে বরাদ্দ রাখা হবে।
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, এখন মানুষের জীবন বাঁচানো সরকারের প্রথম ও প্রধান কাজ হওয়া প্রয়োজন। জীবন বাঁচলে উন্নয়ন হবে।
বাজেট সেভাবে লক্ষ্য নিয়ে আজ উপস্থাপন করা হবে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তিনি বলেন, নতুন বাজেটে দেশের মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা রেখেছি। তাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছি।
বাজেটে কর্মসংস্থান ও খাবারের ব্যবস্থা করার মতো জরুরি কাজগুলোকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার কারণে সরকারের ব্যয় সংকোচনের নির্দেশনা রাখা হচ্ছে আগামী বাজেটে। এ জন্য সরকারি কর্মচারীদের অপ্রয়োজনীয় ও অহেতুক খরচগুলো কাটছাঁট করা হচ্ছে।
সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী বৃদ্ধির পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্যোগকে সহযোগিতা দিতে এবার সরকারকে ব্যাপক কার্যক্রম হাতে নিতে হচ্ছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে যে সব উদ্যোগের কথা এ বাজেটে বলবে তার ভিত্তি হবে ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রণোদনা। ইতোমধ্যে প্রায় এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে। এ প্রণোদনা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ঋণ হিসেবে দেবে। কিন্তু ঋণের বিপরীতে বিপুল পরিমাণ সুদ ভর্তুকি দেবে সরকার। এ কারণে অনুন্নয়ন বাজেট আগামী বছর বাড়ছে। চলতি বছরে সুদ বাবদ পরিশোধ করতে হচ্ছে ৫৭ হাজার হাজার ৬৮ হাজার কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে সুদ বাবদই শোধ করতে হবে ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।